আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় তালাদির নিয়ম ।
তালাদির নিয়ম
অখণ্ড কালকে এক, দ্বি, ত্রি ইত্যাদি মাত্রা সংখ্যানুসারে ছন্দোগত করিয়া বিভাগ করার নাম তাল। ঐ সকল মাত্রার সংখ্যাবিশেষে লঘু গুরু ভেদে ছন্দঃ ও সমাদির বিভিন্নতানুসারে তালবিশেষের নাম নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। তাল দিবার সময় আঘাত এবং বিরাম ( যাহাকে সচরাচর ফাঁক বলে ) এই দুইটারই প্রয়োজন সর্ব্বদা দৃষ্ট হয়। উভয় কর মৃদুবল-সহকারে সংযত করিলে যে আঘাত হয়, তাহাকে সচরাচর তাল কহে ; আর উভয় কর সংযত না করিয়া শুদ্ধ উত্তান করিলে ফাঁক প্রতিপন্ন হইবে।
আঘাতের এই রূপ ( ১ ) এক অঙ্কচিহ্ণ এবং ফাঁকের অর্থাৎ যে স্থানে আঘাত না হইবে, তাহার এই রূপ শূন্য চিহ্ন নির্দিষ্ট আছে। এই উভয়বিধ চিহ্ণই মাত্রাচিহ্ণ দণ্ডের উপরে উপরে থাকিবে, যেমন :- –সাথ” ইত্যাদি। বস্তুতঃ তালটী ছন্দোব্যতীত আর কিছুই নহে। ছন্দঃপ্রভৃতি গ্রন্থে শ্লোকাদির যেমন চারিটী পাদ বা ভাগ থাকে, তালেরও সেইরূপ চারিটা পাদ বা ভাগ আছে। যথা : সম, বিষম, অতীত এবং অনাগত। অনাগত শব্দটী সচরাচর অনাঘাত বলিয়াও ব্যবহৃত হয়।
এই চারিভাগ হইতেই শাস্ত্রকারেরা তালগ্রহণ বিধিবদ্ধ করেন (১) গীতাদির সমকালে যদি তালগ্রহণ করা যায়, তাহার নাম সমগ্রহ ; যদ্যপি পূর্ব্বে গীত আরম্ভ গ্ৰহ ; করিয়া পশ্চাৎ তালগ্রহণ করা হয়, তাহার নাম অতীত যদ্যপি তালগ্রহণের পর গীতাদির আরম্ভ হয়, তাহাকে অনাগত গ্রহ কহে ; আর অতীত এবং অনাগত এতদুভয়ের মধ্যকালে তালগ্রহণের নাম বিষম গ্রহ।
বস্তুতঃ এই চারিপ্রকার গ্রহের মধ্যে সম গ্রহই সর্ব্বপ্রসিদ্ধ, সমের এই রূপ ( + ) পতঙ্গ চিহ্ন। এই চিহ্ণটীও মাত্রাচিহ্ণের উপরি- ভাগে থাকিবে। ফাঁক স্থান হইতেও তালগ্রহণের ব্যবহার আমাদের দেশীয় রীত্যনু- সারে দেখিতে পাওয়া যায়; তালে যথানির্দিষ্ট লয় ( ১ ) স্থির রাখা অতি কৰ্ত্তব্য।
লয়প্রবৃত্তির নিয়মকে যতি কহে (২), অর্থাৎ প্রবৃত্তিসূচক নিয়মানু- যায়িক ছন্দোগত বিশ্রাম বিশেষের দ্বারা কোন তালবিশেষের লয়ের সহিত অন্য তালবিশেষের লয়ের যে বিভেদ দেখা যায়, তাহার নাম যতি। যতিচিহ্ণ এইরূপ, ( 6 ) ইহাও দণ্ডচিহ্ণের উপর উপর থাকে, যেমন :- সা ইত্যাদি। যেখানে তালবিশেষের একটা পূর্ণমঞ্চ অর্থাৎ “আওদা” বা “ফেরা” পরিসমাপ্তি হয়, তাহাকে মানবা বিশ্রামস্থান বলে।
প্রত্যেক মঞ্চ মাত্রানুযায়িক বিরামান্তে এক একটা + বিভাজক রেখা দ্বারা ভাগ করা কর্তব্য; যেমন :— সাগতম। প্রাচীন সংস্কৃত রীতিতে প্রায়ই সমস্থান হইতে তালটী গৃহীত হইয়া ফাঁক স্থানে বিরামান্তে একটী পূর্ণমঞ্চ সমাপন করে। পুনর্ব্বার সমস্থানে তালের পুনগ্রহণ হইয়া থাকে, সংস্কৃতমতানুযায়ী দ্রুত ত্রিতালী তাল যথা :-
সা – । পরন্ত এক্ষণকার প্রচলিত মতে সেটী অবিকল হয় না, আধুনিক গায়কেরা তালটী সমস্থান হইতে গ্রহণকরণানন্তর যথাযোগ্য ফাঁক অর্থাৎ শূন্যস্থানে বিরাম না করিয়া পুনর্ব্বার সমে সমাপন করেন,
যেমন :- + – স গ ম সা । কথিত উদাহরণটী দ্রুত ত্রিতালী বা কাওয়ালীর ( ১ ) আধুনিক নিয়মানুযায়িক একটা পূর্ণমঞ্চ প্রতিপন্ন করিতেছে। বস্তুতঃ দ্রুত ত্রিতালী চারি মাত্রায় সম্পন্ন হয়। চলিত মতে দ্রুত ত্রিতালী সম হইতে গ্রহণানন্তর ফাঁকে বিশ্রাম না করিয়া পুনর্ব্বার সমস্থানে বিরাম করিতে গেলে শাস্ত্র এবং যুক্তি এতদুভয়তই দৃষ্য হইয়া পড়ে ৷
যেহেতু প্রথম মাত্রাতে দ্রুত ত্রিতালীর সম হইয়া চতুর্থ মাত্রা ফাঁকা স্থানে তালের বিরাম হওয়া কৰ্ত্তব্য। কিন্তু চতুর্থ মাত্রাতে বিরাম না করিয়া পুনর্ব্বার প্রথম মাত্রা সমস্থানে আসিলে দ্রুত ত্রিতালী পাঁচটী মাত্রার তাল হইয়া পড়ে। চারিমাত্রাবিশিষ্ট তালকে পাঁচমাত্রাবিশিষ্ট করা নিতান্ত অযৌক্তেয়।
যদ্যপি কেহ এমন সন্দেহ করেন যে, চারিমাত্রাবিশিষ্ট দ্রুত ত্রিতালী তাল, পাঁচমাত্রা- বিশিষ্ট হইলে সঙ্গতে বেতালা হয় না কেন ? তাহার সদুত্তর এই যে, আমাদের দেশে তালবিরামে মঞ্চ মঞ্চ ভাগ করার রীতি নাই, যে স্থান হইতে তালগ্রহণ হইয়াছে, সেই গ্রহণস্থানে প্রতিগ্রহণে প্রতিবার “ হা ” দেওয়া ব্যবহার আছে, অবিচ্ছেদে সঙ্গত হওয়া জন্য মধ্যে মধ্যে সেই বিরামকাল যে দৃয্য, সহসা তাহা বোধ হয় না। পরন্ত গানাদির অবসানে সেই সমে আসিয়া যেমন “হা” দিবেন, তখন সমস্থানে বিরামজন্য তালানুযায়িক নির্দ্দিষ্ট মাত্রা অপেক্ষা একটী মাত্রা অধিক হইবে।
যেমন দুই সপ্তাহে চতুৰ্দ্দশ দিবস মাত্র, অর্থাৎ এক রবিবার হইতে গণনা আরম্ভ করিয়া পর সপ্তাহের শনিবার পর্যন্ত গণনাবসান হইলে চতুদশ দিবস পূর্ণ হয়, কিন্তু যদ্যপি পূর্ব্ব সপ্তাহের রবিবার হইতে গণনারম্ভ করিয়া পর সপ্তাহের শনিবারে গণনা শেষ না করিয়া তৃতীয়সপ্তাহের প্রথম গ্রহণদিবস রবিবার পর্য্যন্ত লইয়া গণনা সমাপ্ত করা যায়, তাহাতে দুই সপ্তাহে অর্থাৎ চতুর্দ্দশ দিবস মধ্যে তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিবস গ্রহণজন্য অপেক্ষাকৃত কি একদিন অধিক হইবে না ? পরন্তু ক্রমান্বয়ে সপ্তাহ সপ্তাহ গণনা করিলে ঐ দোষ অনুভব হওয়া দুষ্কর।
পাঠক! বিবেচনা করিবেন, কোন তালবিশেষের সমস্থান হইতে আরম্ভ করণানন্তর যথাযোগ্য স্থানে বিরাম না করিয়া পুনগ্রহণস্থানে বিরাম করাও তদনুরূপ কি না ? যাবতীয় তালসম্বন্ধে যে, এইরূপ ব্যবহারানুযায়িক বিশ্রামবৈপরীত্য ঘটিয়া থাকে, তাহা কদাচ নহে । এমন অনেক তাল আছে, যাহা সংস্কৃতানুযায়িক তাল-বিশ্রামস্থলে ব্যবহারানুগত বিরামও হইয়া থাকে। পরন্তু এস্থলে সে সকল কথার বিশেষ প্রয়োজন করে না ।
সেতারের গতে প্রায় সাধারণতঃ তিন চারিটী তালের অধিক প্রয়ো- জন দৃষ্ট হয় না, তন্মধ্যে দ্রুত ত্রিতালী, মধ্যমান এবং শ্লথ-ত্রিতালীর গই অধিক, এতদ্ব্যতীত একতালা, কদাচিৎ সওয়ারী বা পঞ্চমসওয়ারী এবং অন্যান্য তালেরও প্রয়োজন হইয়া থাকে। গতাদিতে যেমন ডা রা, ডি রি ইত্যাদি কতকগুলি কাল্পনিক বোলের ব্যবহার দৃষ্ট হয়, তেমনি তালসম্বন্ধেও সঙ্গতি করিবার সময় ধাধিন, ধিন, তেটে, কেটে, থুনা, রে প্রভৃতি বহুবিধ বোলেরও প্রয়োজন হইয়া থাকে। পরন্তু এই সকল বোল বর্ণানুযায়িক মাত্রানুসারে ব্যবহৃত না হইয়া তালগত মাত্রানুসারে প্রতিপন্ন হয় ।
দ্রুত ত্রিতালী
দ্রুত ত্রিতালী চারিটী লঘু মাত্রার তাল । যথা :-
ধাধিন্ধা, ধাধিঙ্কা, তিতিস্তা, নাধিন্ধা ।
মধ্যমান
মধ্যমান চারিটী দীর্ঘ অথবা আটা লঘু মাত্রার তাল। যথা :-
ধিদ্ধা ধিধী, বিদ্ধা ধিধী, ধিত্তা তিতী, তিদ্ধা ধিধী। কথিত অষ্টমাত্রা-বিশিষ্ট মধ্যমান তাল চারিমাত্রা-বিশিষ্ট দ্রুত- ত্রিতালী অপেক্ষা দ্বিগুণ গুরুভাবে ব্যবহার্য্য।
শখ-ত্রিতালী
শ্লথ-ত্রিতালী চারিটী প্লুত অথবা ষোলটা লঘু মাত্রার তাল । যথা :-
ধা ধিন্না, ত্রেকে ধা ধিন্না, থুন থুন্না, তেটা খেতা গেদা যিনি । এই তালটা এইরূপে ব্যবহার হয়, শ্লথ-ত্রিতালী, কাওয়ালী অপেক্ষা চতুর্গুণ এবং মধ্যমান অপেক্ষা দ্বিগুণ গুরু।
একতাল
একতালা তিনটী দীর্ঘ অথবা ছয়টা লঘু মাত্রার তাল। যথা :–
ধিনি ধাগ্, থুনা তেটে, ধা খুনা । চৌতাল ।
চৌতাল
দুইটী দীর্ঘ ও দুইটী লঘু মাত্রার তাল । যথা :-
ধাগে, দিনতা, ‘কভাগি, দিনতা, তেটিকতা, গেদাখিনি।
স্থরফাক্তা
দুইটী দীর্ঘ ও একটী লঘু মাত্রার তাল । যথা : – ধাধিন, নাগদিৎ, ধিনিনাক্, গদ্দী, খিনিনাক্ ।
ঝাঁপতাল ।
ঝাঁপতাল দুইটী দীর্ঘ ও দুইটী প্লুত মাত্রার তাল । যথা : –
ধাগে, ধাগে দিন, তাকে, ধাগে দিন ।
ধামার
ধামার সাত মাত্রার তাল । যথা :-
কেধে টে, ধেটে, ধা, গদি নে, দেনে তা ।
আড়া-চৌতাল
আড়া-চৌতাল একটী লঘু ও তিনটী দীর্ঘ মাত্রার তাল । যথা :—
ধিনি, ধাধা, ধুনা, তেটে, তাধি, নাধি, ধিনা ৷
পঞ্চম-সওয়ারী
পঞ্চম-সওয়ারী পঞ্চদশ মাত্রার তাল । যথা : –
ধি নাক্, ধি নাক্, তাক্ থুনা, কেটে থুনা, কৎ থুনা, কেটেতাক্ থুনা, কেটে তাধি, নেধা কেটেতাক্ ।
যখন উপরোক্ত বোলযোগে গীতাদির সহিত সঙ্গতি করা যায়, তখন ঐ সকল বোলের উচ্চারণ কিঞ্চিৎ কাল-সাপেক্ষ ; তজ্জন্য পাঁচ পাঁচটী হ্রস্ব অক্ষর উচ্চারণের কাল অর্থাৎ ক, খ, গ, ঘ, ঙ, এই পাঁচটী বর্ণের উচ্চারণকাল একমাত্রকাল বলিয়। ব্যবহৃত হয়, ইহা সঙ্গীতশাস্ত্রসিদ্ধ (১)।
আরও দেখুনঃ
1 thought on “তালাদির নিয়ম”