ভারতীয় সেতার সঙ্গীত: একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি

ভারতীয় সঙ্গীতের জগতে সেতার একটি অতুলনীয় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিচিত। এর সূক্ষ্ম স্বর, মনমুগ্ধকর সুর, এবং জটিল রাগভিত্তিক সঙ্গীত সৃষ্টি করার ক্ষমতা সেতারকে একটি বিশেষ অবস্থানে স্থান দিয়েছে। সেতারের ইতিহাস, নির্মাণ, বাজানোর পদ্ধতি এবং প্রখ্যাত সেতারবাদকদের কাহিনী নিয়ে এই নিবন্ধে বিশদ আলোচনা করা হবে।

ভারতীয় সেতার সঙ্গীত: একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি

সেতারের ইতিহাস

সেতার শব্দটি এসেছে পার্সি ভাষার ‘সেহ তার’ থেকে, যার অর্থ ‘তিন তার’। যদিও সেতারের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক মতভেদ রয়েছে, সাধারণত মনে করা হয় যে এটি প্রাচীন ভারতে উদ্ভূত হয়েছে এবং পরে পারস্য থেকে প্রভাবিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। সেতার মূলত ত্রিতন্ত্রী বীণা থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

 

ভারতীয় সেতার সঙ্গীত: একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি

সেতারের নির্মাণ

সেতারের গঠন অত্যন্ত জটিল এবং সূক্ষ্ম। এর প্রধান অংশগুলি হলো:

  • তুম্বা: সেতারের নিচের বড় গোলাকার অংশটি যা শবদ উৎপন্ন করতে সাহায্য করে।
  • দাণ্ড:এটি একটি দীর্ঘ কাঠের অংশ যা সেতারের মূল শরীর গঠন করে। এর উপর তারগুলি স্থাপন করা হয়।
  • তার: সাধারণত সেতারে সাতটি প্রধান তার থাকে – চারটি মেলোডি তার এবং তিনটি সহায়ক তার।
  • ফ্রেট: সেতারে ধাতুর তৈরি ২০-২১টি ফ্রেট থাকে, যা বিভিন্ন স্বর ও সুর তৈরি করতে সাহায্য করে।
  • গুরু: সেতারে এক বা দুটি গুরু থাকে যা সুর ঠিক করতে সাহায্য করে।

সেতার বাজানোর পদ্ধতি

সেতার বাজানোর জন্য প্রধানত পিক বা মিজরাব ব্যবহার করা হয়, যা ডান হাতের আঙুলে পরা হয়। সেতারের সুর ও স্বর তৈরি করার জন্য বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে তারের উপর চাপ দেওয়া হয়। সেতারে বিভিন্ন রাগ বাজানোর জন্য বিশেষ রীতি ও নিয়ম মেনে চলা হয়। প্রতিটি রাগের একটি নির্দিষ্ট সময় ও ঋতু থাকে এবং সেগুলির নিজস্ব মেজাজ ও আবেগ প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকে।

রাগ সঙ্গীত

রাগ সঙ্গীত হল সেতারের মূল ভিত্তি। রাগ হল একটি সংগীতের কাঠামো যা নির্দিষ্ট স্বর ও স্বরের সংমিশ্রণে তৈরি হয়। প্রতিটি রাগের নিজস্ব চরিত্র, আবেগ, এবং সময় থাকে। রাগগুলি মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত হয় – মেলোডি বা আলাপ এবং তাল বা জোর। আলাপে সেতারবাদক সুরের মাধ্যমে রাগের পরিচয় দেন এবং ধীরে ধীরে তা বিস্তার করেন। জোরে তাল ও লয়ের মাধ্যমে রাগকে সম্পূর্ণ করা হয়।

প্রখ্যাত সেতারবাদক

ভারতীয় সেতার সঙ্গীতের ইতিহাসে অনেক মহান সেতারবাদক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের উল্লেখ করা হলো:

  • পণ্ডিত রবি শংকর: সেতারের জগতে পণ্ডিত রবি শংকর এক অমর নাম। তিনি সেতারকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরেছেন এবং পশ্চিমা সঙ্গীতের সঙ্গে একীভূত করেছেন। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা ও শিক্ষা সারা বিশ্বে প্রশংসিত।
  • উস্তাদ ভিলায়েত খান: উস্তাদ ভিলায়েত খান ছিলেন সেতারের আরেকজন কিংবদন্তি শিল্পী। তাঁর গায়কী আঙ্গিকের সেতার বাজানোর পদ্ধতি সেতার সঙ্গীতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
  • পণ্ডিত নীখিল ব্যানার্জী: পণ্ডিত নীখিল ব্যানার্জী ছিলেন আরেকজন প্রখ্যাত সেতারবাদক। তাঁর সুর ও স্বরের গভীরতা শ্রোতাদের মুগ্ধ করত।
  • উস্তাদ শওকত হুসেন খান: উস্তাদ শওকত হুসেন খান ছিলেন একজন প্রতিভাবান সেতারবাদক, যিনি তাঁর নিজস্ব শৈলীতে সেতার বাজানোর মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন।

 

 

সেতারের আধুনিক প্রভাব

আধুনিক যুগে সেতারের প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমা সঙ্গীত, বিশেষ করে রক এবং জ্যাজ সঙ্গীতে সেতারের ব্যবহার জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জর্জ হ্যারিসন, বীটলসের একজন সদস্য, পণ্ডিত রবি শংকরের কাছে সেতার শিখেছিলেন এবং এর প্রভাব বীটলসের অনেক গানে দেখা যায়।

সেতার একটি অতুলনীয় বাদ্যযন্ত্র যা ভারতীয় সঙ্গীতের আত্মা ও সংস্কৃতির প্রতীক। এর সূক্ষ্ম সুর ও জটিল রাগভিত্তিক সঙ্গীত শ্রোতাদের মনমুগ্ধ করে। সেতারের ইতিহাস, নির্মাণ, বাজানোর পদ্ধতি, এবং প্রখ্যাত সেতারবাদকদের অবদান সেতার সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছে। সেতারের এই ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক প্রভাব সঙ্গীতের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সেতারের অনুপ্রেরণা ও শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।

আরও দেখুন:

Leave a Comment