আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ষড়জাদি সপ্তস্বর। স্নিগ্ধ, অথচ রঞ্জনগুণবিশিষ্ট ধ্বনিবিশেষের নাম স্বর। স্বরই সঙ্গী- তের মূল। যজ্ঞ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত এবং নিষাদ এই সাতটী শুদ্ধস্বর। ইহাদের প্রত্যেককে এক একটা ধাতু বলে। সচরাচর কথোপকথনে প্রত্যেক স্বরের সাঙ্কেতিক নাম সা, ঋ, গ, ম, প, ধ ও নি মাত্র ব্যবহার করা যায়। কথিত সা, ঋ, গ, ম, প, ধ ও নি একত্র করিলে গ্রাম বা সপ্তক সংজ্ঞা হয়। সপ্তক অসংখ্য, কিন্তু মনুষ্যকণ্ঠে উদারা, মুদারা এবং তারা এই তিনটীমাত্র সপ্তক উত্তম রূপে সংসা- ধিত হইয়। থাকে । গ্রাম বা সপ্তক লিখিবার প্রণালী নিম্নে প্রদর্শিত হইতেছে।
ষড়জাদি সপ্তস্বর
স্বরসমুদায় লিপিবদ্ধ করিতে হইলে একটা সরল রেখা টানিয়া তাহার নিম্নে সা, ঋ, গ, ইত্যাদি সপ্ত স্বর লিখিয়া সপ্তকত্রয়ের পার্থক্য জ্ঞাপনার্থ উদারাসপ্তকের স্বরসমূহের নিম্নে এক একটা বিন্দু দেওয়া যাইবে ; মুদারাসপ্তকের স্বর যেমন তেমনি থাকিবে এবং তারাসপ্তকের স্বরের উপরিভাগে এক একটা বিন্দু যোগ করা যাইবে। যথা;—
এই প্রণালীতে শুদ্ধ ত্রিসপ্তক কেন, অনন্ত সপ্তক এক রেখাতে লেখা যাইতে পারিবে। কেবল মুদারার নিম্ন ও উচ্চ সপ্তকের সংখ্যানু- সারে স্বরসমূহের নিম্নে ও উচ্চে বিন্দু দিলেই হইবে। যথা; – সা, সাঁ, এই দুইটী সার মধ্যে প্রথমটীদ্বারা উদারার নিম্ন সপ্তক এবং দ্বিতীয়টী দ্বারা তারার উচ্চ সপ্তক জানা যাইতেছে ৷
সেতার যন্ত্রে সচরাচর পূর্ণ উদারা, মুদারা এবং তারাসপ্তকের অর্দ্ধ অর্থাৎ সা, ঋ, গ ও ম পর্যন্ত এই আড়াই-সপ্তকের অধিক প্রায় থাকে না। নিম্ন-অঙ্কিত প্রতিমূর্ত্তির হস্তস্থিত সেতারের একাদি অঙ্কবিশিষ্ট সতেরখানি পর্দ্দার বিবরণ বিশেষরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেই সেতার যন্ত্রে ঐ সার্দ্ধ দ্বিসপ্তক কি নিয়মে বিন্যস্ত থাকে ও সংসাধিত হয়, তাহা অনায়াসে বোধগম্য হইবে।
প্রথমে দক্ষিণ হস্তের তর্জ্জনীতে মিজ্রাপ্ পরিয়া সেতারটী বাম- হস্তে যথানিয়মে ধরিতে হয়। তদনন্তর মিথ্রাপ্ দিয়া দুই চিহ্নবিশিষ্ট জুড়ীর কাঁচা তার ছাড়িয়া আঘাত করিলে উদারার ষড়জ হইবে। বাম হস্তের তর্জ্জনীদ্বারা ঐ কাঁচা তার দ্বিতীয় পর্দায় চাপিয়৷ ঐরূপ আঘাত করিলে উদারার ঋষভ হইবে।
বাম হস্তের মধ্যমাঙ্গুলীদ্বারা ঐ তার তৃতীয় পৰ্দ্দায় চাপিয়া আঘাত করিলে উদারার গান্ধার হইবে। নায়কী তার ছাড়িয়া আঘাত করিলে উদারার মধ্যম হইবে, নায়কী তার তর্জ্জনীদ্বারা দ্বিতীয় পৰ্দ্দায় চাপিয়া আঘাত করিলে উদারার পঞ্চম হইবে। নায়কী তার মধ্যমাঙ্গুলীদ্বারা তৃতীয় পর্দায় চাপিয়া আঘাত করিলে উদারার ধৈবত হইবে এবং ঐ তার মধ্যমাঙ্গুলীদ্বারা পঞ্চম পর্দায় চাপিয়া আঘাত করিলে উদারার নিষাদ হইবে। এই প্রণালীতে প্রথমে উদারাসপ্তকের স্বরগ্রাম স্থির হয়।
পরে মধ্যমাঙ্গুলি দ্বারা নায়কী তার ষষ্ঠ পর্দায় চাপিয় | আঘাত করিলে মুদারার ষড়জ হইবে। ঐ নিয়মে সপ্তম পর্দায় ঋষভ, অষ্টম পর্দায় গান্ধার, নবম পৰ্দ্দায় মধ্যম, একাদশ পর্দায় পঞ্চম, দ্বাদশ পৰ্দ্দায় ধৈবত, এবং ত্রয়োদশ পর্দায় নিষাদ সম্পন্ন হয়। এই সাতটী সুরকে মুদারা সপ্তকের স্বর কহে। সচরাচর গান বা বাদ্য আরম্ভসময়ে ‘মুদারা সপ্তকই অবলম্বনীয়, ইহার বিশেষ কারণ সঙ্গীতসারে সপ্তক প্রকরণে দ্রষ্টব্য।
নায়কী তার মধ্যমাঙ্গুলি দ্বারা চতুর্দ্দশ পর্দাতে চাপিয়া দক্ষিণ হস্তের মিজ়াপযুক্ত তর্জ্জনীর আঘাত করিলে তারাগ্রামের ষড়জ, পঞ্চদশ পর্দ্দায় তারার ঋষভ, ষোড়শ পর্দ্দাতে তারার গান্ধার এবং সপ্তদশ পর্দাতে তারার মধ্যম সম্পন্ন হয়। এই নিয়মে আড়াই সপ্তক সেতারে সম্পন্ন হইয়া থাকে। দক্ষিণ হস্তের আঘাতগুলি পদা সকলের শেষে যে খালি স্থান আছে, সেইখানকার তারে হওয়া উচিত, তাহা না হইলে শব্দ উত্তমরূপে প্রকাশ পাইবে না। প্রথম, চতুর্থ এবং দশম এই তিন খানি পর্দ্দার স্বর প্রকৃত স্বর নহে।
প্রথমখানির নাম উদারার কড়ি মধ্যম, স্বাভাবিক মধ্যম হইতে এই স্বর কিঞ্চিৎ চড়া অর্থাৎ উচ্চ। যাবনিক ভাষায় কড়ি শব্দে উচ্চতাকে বুঝায়। চতুর্থ পর্দ্দার স্বরের নাম উদারার কোমল নিষাদ, অর্থাৎ ইহা স্বাভাবিক নিষাদ হইতে কিঞ্চিৎ ন্যূন। দশম পর্দ্দার স্বরটীর নাম মুদারার কড়ি মধ্যম।
কোন তীব্র স্বরকে স্বরলিপিবদ্ধ করিতে হইলে পূর্ব্বোক্ত রেখাতে লিখিত প্রকৃত স্বরের মস্তকে এইরূপ (+) পতাকা চিহ্ন দেওয়া যাইবে । যে স্বরের মস্তকে এইরূপ চিহ্ন থাকিবে, তাহাকে তীব্র স্বর বলিয়া জানা কৰ্ত্তব্য, পতাকা চিহ্নই তীব্রতাজ্ঞাপক চিহ্ন, কিন্তু যদ্যপি ঐ পতাকা চিহ্নটা আবার এইরূপ ( 1 ) বিন্দুযুক্ত হয়, তবে তাহা অতিতীব্রতা- জ্ঞাপক বলিয়া জানিতে হইবে। যে প্রকৃত স্বরের উপর এইরূপ (4) ত্রিকোণ চিহ্ন থাকিবে, সেটীকে কোমল স্বর বলিয়া জ্ঞান করা কর্তব্য, কিন্তু যদ্যপি আবার ঐ ত্রিকোণ চিহ্নটা এইরূপ ( 4 ) বিন্দুযুক্ত হয়, তবে তাহাকে অতিকোমলতাজ্ঞাপক বলিয়। জানিতে হইবে ।
সতেরখানি পর্দাবিশিষ্ট সেতার যন্ত্রে উক্ত তীব্র এবং কোমল – সুরের সহিত সার্দ্ধ দ্বিসপ্তক অর্থাৎ পূর্ণ উদারা, মুদারা এবং তারা গ্রামের সা, ঋ, গ ও ম এই চারিটী স্বর মাত্র যে প্রকারে বিন্যস্ত থাকে, অবিকল সেইরূপ স্বরলিপি নিম্নে লিখিত হইতেছে।
উদারা সপ্তকের সা, ঋ ও গ এই তিনটী স্বর পূর্ব্ব-কথিত নিয়মে কাঁচা তারে সাধন জন্য উহাদের মস্তকে কোন সংখ্যা অঙ্কিত হয় নাই। কথিত হইয়াছে নায়কী তার ছাড়িয়া আঘাত করিলে উদারার মধ্যম হইবে, সেই জন্য উদারার মধ্যমের উপর একাদি সংখ্যার প্রয়োজন করে না ; যেহেতু প্রথম পর্দা উদারার তীব্র মধ্যম হইতে আরম্ভ হইয়া সেতারে সংখ্যাতে সতেরখানি পর্দা হইয়া থাকে,সেই জন্য ঐ কড়ি মধ্যম হইতে একাদিক্রমে সতের পর্য্যন্ত সংখ্যা প্রত্যেক সুরের মস্তকে লিখিত হইল।
বস্তুতঃ স্বরলিপি মাত্রেই যে, প্রত্যেক স্বর একাদি সংখ্যাবিশিষ্ট করিয়া লিখিতে হইবে এমন নহে, কেবল সেতার যন্ত্রের পর্দা কয়েক খানির স্বরলিপির সহিত সম্বন্ধ, প্রথম পাঠার্থীদিগকে সহজে বুঝাইবার জন্য উপরি লিখিত স্থরগুলি একাদি সংখ্যাযোগে লিখিত হইয়াছে ।
ষড়জাদি সপ্ত স্বরের উর্দ্ধগতির নাম অনুলোম, যেমন সা, ঋ, গ, ম, প, ধ ও নি । সপ্ত স্বরের অধোগতির নাম বিলোম, যেমন নি, ধ, প, ম, গ, ঋ, সা। গায়কেরা সচরাচর প্রথমোক্ত গতিকে আরোহী এবং শেষোক্তটীকে অবরোহী বলিয়া থাকেন।
পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, সা, ঋ, গ ও ম ইত্যাদি সাতটী স্বরকে সাতটী ধাতু এবং ক-আদি বর্ণ উচ্চারণকালকে মাত্রা বলে। প্রাচীন পণ্ডিতদিগের মতে মাত্ৰা পাঁচ প্রকার, যথা ;–হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুত, অর্দ্ধ এবং অণু। সহজে একটীমাত্র লঘু বর্ণ উচ্চারণ করিতে যে সময়ের আবশ্যক, তাহাকে একমাত্র অথবা হ্রস্বমাত্র কাল বলা যায়; তাহার চিহ্ন এইরূপ (1) একটী দণ্ড ; উদাহরণ যথা ;– সা ইত্যাদি।
দুইটী লঘু বর্ণ সহজে উচ্চারণ করিতে যে সময়ের প্রয়োজন, সেই সময়ের নাম দ্বিমাত্র বা দীর্ঘমাত্র কাল; তাহার চিহ্ন এইরূপ ( ॥ ) দুইটী দণ্ড, উদাহরণ যথা ;- সাঁতল্ক ইত্যাদি। তিনটী লঘু বর্ণ উচ্চারণের যে সময়, তাহাকে ত্রিমাত্র
অথবা প্লুতমাত্র কাল কহে, তাহার চিহ্ন এইরূপ (!!!) তিনটী দণ্ড, উদাহরণ যথা ; – স ঋ ইত্যাদি। তিন মাত্রার অতিরিক্ত মাত্রা হইলেও তাহাকে প্লুত মাত্রা বল। যায়। তিন মাত্রার অতিরিক্ত যত মাত্রা হইবে, সেই মাত্রার সংখ্যানুসারে উপরি উক্ত দণ্ড চিহ্ন নিদ্দিষ্ট হইবে।
মনে কর যেন কোন স্থানে ছয়মাত্র কালের প্রয়ো- জন আছে, সে স্থলে সেই ছয়টা মাত্রা লিখিবার জন্য ছয়টা দণ্ড- চিহ্ন লিখিতে হইবে, উদাহরণ যথা ; – স ঋ ইত্যাদি। গানাদিতে প্লুত মাত্রারই অধিক প্রয়োজন দেখিতে পাওয়া যায়। এক মাত্রার অর্দ্ধেকটুকু সময়ের নাম ব্যঞ্জন বা অৰ্দ্ধমাত্র কাল, দুইটা অৰ্দ্ধ মাত্রা উচ্চারণে একমাত্র কাল সম্পন্ন হইয়া থাকে। এইরূপ (৩) অৰ্দ্ধচন্দ্র
চিহ্নই অৰ্দ্ধমাত্রাকালজ্ঞাপক চিহ্ন ; উদাহরণ যথা ; – সাঁঝ ইত্যাদি। – এই চিহ্নটা এক, দুই ইত্যাদি মাত্রার সহিত একত্র লিখিবার সময় দণ্ড চিহ্নের পার্শ্বে পার্শ্বে থাকিবে, যেমন সাঁত ইত্যাদি। গীতে কখন কখন অণ মাত্রা অর্থাৎ অর্দ্ধমাত্রার অর্দ্ধমাত্রা ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়, দুইটী অণুমাত্রাতে একটী অর্দ্ধমাত্রা এবং চারিটী অণুমাত্রাতে একটা পূর্ণ মাত্রা সম্পন্ন হইয়া থাকে।
অণুমাত্রার এইরূপ ( * ) ডমরুচিহ্ন, এই চিহ্নটাও অর্দ্ধমাত্রার অনুরূপভাবে লিখিত হইবে। যথা ; – সাঁ সাঁ ইত্যাদি। প্রাচীন পণ্ডিতেরা উক্ত পাঁচপ্রকার মাত্রাদ্বারাই সঙ্গীতক্রিয়া লিপিবদ্ধ করিতেন, কিন্তু আমাদিগের বিবেচনায় উক্ত পঞ্চবিধ মাত্রাদ্বারা কখনই স্বর বা স্বরসমূহের বিশেষ বিশেষ স্থিতিকাল সুন্দররূপে হৃদয়ঙ্গম হইতে পারে না, অতএব এস্থলে আরও কয়েকটী মাত্রাজ্ঞাপক চিহ্ন প্রকটিত করা গেল।
স্বর এক মাত্রার দুই তৃতীয়াংশ কাল স্থায়ী হইলে এইরূপ (+) বাণ চিহ্ন,তৃতীয়াংশকাল স্থায়ী হইলে এইরূপ (+) ত্রিশূল চিহ্ন, অষ্টমাংশ কাল স্থায়ী হইলে এইরূপ ( 0 ) যব চিহ্ন এবং ষোড়- শাংশ কাল স্থায়ী হইলে এইরূপ ( * ) নক্ষত্র চিহ্ন দেওয়া যাইবে; এই সকল মাত্রা চিহ্নও স্বরের উপরে উপরে থাকিবে। যথা ; – সাল্কা গ ইত্যাদি। বোধ করি পূর্ব্বোক্ত পাঁচ প্রকার এবং এই চতুর্বিধ মাত্রার যোগেই স্বরলিপি অপেক্ষাকৃত বিশদ হইতে পারিবে। কথিত ধাতু এবং মাত্রা এতদুভয়ে মিলিত হইয়া প্ৰকাশ পাইলে তাহাকে প্রকৃত গীত বলা যায় ।
গীত দুই প্রকার, গাত্রজ এবং যন্ত্রজ। যে গীত মনুষ্যকণ্ঠে সুস্পষ্ট- রূপে উৎপাদিত হইয়। লোকের চিত্ত রঞ্জন করে, তাহার নাম কণ্ঠগীত, আর যে গীত বীণা অথবা সেতারাদি যন্ত্রে প্রতিপন্ন হয়, তাহার নাম যন্ত্রগীত ।
কথিত হইয়াছে কালজ্ঞাপক মাত্রাচিহ্ন প্রত্যেক সুরের উপরে উপরে দেওয়া থাকিবে, যেখানে কোন সুরের উপর মাত্রাচিহ্ন আছে, অথচ ঐ সুরের পর একটা অথবা তদতিরিক্ত সুরের উপর কোন মাত্ৰা- চিহ্ন নাই, সে হলে পূর্ব্ব সুরের উপরিস্থিত নির্দ্দিষ্ট মাত্রাকালের মধ্যে সমুদয় নির্মাত্র পর স্থরগুলি সমভাবে প্রকাশিত হইবে এবং নির্মাত্র সুর- গুলি মাত্রাবিশিষ্ট সুরের সহিত একটী বন্ধনীদ্বারা পরস্পর সংযত থাকিবে, যেমন সাম্মান ইত্যাদি।
আরও দেখুনঃ
2 thoughts on “ষড়জাদি সপ্তস্বর”