সেতার থেকে আওয়াজ বের করা নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পর্বে, আমরা আলোচনা করবো, সেতার থেকে আওয়াজ বের করবার সহজ উপায় বা কৌশল নিয়ে। সেতার থেকে আওয়াজ বের করবার আগে শুরুতেই চারটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বুঝে নেয়া জরুরি। প্রথমটি হলো সেতার নিয়ে বসা, দ্বিতীয়টি মিজরাবের সঠিক নির্বাচন, তৃতীয়টি ডান হাতের সঠিক মুদ্রা এবং চতুর্থত মিজরাব দিয়ে তারে আঘাত/স্ট্রোক করবার কায়দা।
প্রথমত, শিক্ষার্থীরা সেতার নিয়ে মোটামুটি আরামদায়কভাবে বসতে পারছে কিনা তা নিশ্চিত করা অবশ্যক। সেতার গুরুকুলের দ্বিতীয় পর্বে আমরা সেতার নিয়ে বসার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেতার নিয়ে বসা এবং সঠিক উপায়ে সেতার ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শারীরিক গঠনে ভিন্নতা থাকবে। তাই নিজের সুবিধামত একটা কায়দা বের করে নেয়ার আগে, নিজেকে একটু জোর করে হলেও, সেতার গুরুকুলে দেখানো পদ্ধতিটি রপ্ত করার চেষ্টা চলমান রাখলে বড় ধরণের ভুল এড়ানো সম্ভব হবে।
দ্বিতীয়ত, সঠিক মিজরাব নির্বাচন। সেতার ছাড়াও, একই ধরনের মিজরাব সুরবাহার এবং নানা ধরনের বীণাসহ কিছু ফার্সি তার যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়। মিজরাব একেবারেই হাতে বানানো হয়, তাই প্রতিটা মিজরাবের মাপ আলাদা। মিজরাব বিভিন্ন সময় নানা ধরনের রুপালি ধাতু দিয়ে তৈরি করা হতো। বিগত কিছু বছর ধরে, দাতবাধাই করবার বিশেষ “স্টেইনলেস স্টিল” তার দিয়ে মিজরাব বানানো হয়, যা মরচে ধরে না। তবে ইদানিং, আরও উন্নত মানের একই ধাতুর তার দিয়ে বানানো মিজরাব গুলোই সেরা। মিজরাবে তারের পুরুত্বের উপরেও সেতারের আওয়াজ কিছুটা নির্ভরশীল। ডান হাতের তর্জনীর ডগা নিচে প্রথম কর বরাবর দু’পাশে আঙুলের জোড়া, বা “জয়ন্ট”। মূলত, এই জোড়া থেকে আঙুলের ডগা পেরিয়ে খানিকটা বাইরে থেকেও, উপরে এবং নিচে মিজরাব নরছে না, এমন মিজরাবকেই আদর্শ হিসেবে নেয়া হয়। নতুন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে “রাবার গ্রিপ”সহ মিজরাব কিনলে কিছুটা আরামদায়ক হয়। অনেকসময়, আঙুলের তুলনায় মিজরাব বেশি বড় হয়ে থাকলে, আঙুলে ২-৩ স্তর মেডিকেটেড টেপ অথবা ব্যান্ডেইড ব্যাবহার করা যেতে পারে। সেতার ধরেই, মিজরাবটি ঠিক মত আঙুলে পরানো আছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে।
তৃতীয়ত, ডান হাতের মুদ্রা। মহারথিদের সেতার বাজনায়, আপাত দৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ ডান হাতের “ডারা” বোলের কৌশল বুঝেফেলা কঠিন। বেশ কিছু ব্যাপার ভেবে সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমেই দুর্দান্ত আওাজের সাথে হাতের ক্লান্তিহীন “দম” আয়ত্তে আনা সম্ভব। এখানে, মূল চিন্তাটা রাখতে হবে, শুধু হাতের তালু এবং আঙুলের পেশির জোড় ব্যবহার না করে, ডান কাঁধ থেকে শুরু করে আঙুলের শেষ কব্জি/গ্রন্থির শক্তি ব্যবহার করতে হবে। আঙুল এবং পাঞ্জার পেশি তুলনামূলক ছোট হওয়ায় হাতের এই অংশ বেশ তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সাধারনত, দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো করতে হাতের স্বাভাবিক ভঙ্গি নিয়ে এত বিস্তৃত চিন্তা করতে হয়না, তাই এইভাবে ভাবতে কিছুটা সময় লেগে যাওয়া স্বাভাবিক।
এবার, ডান হাতের কনুইয়ের ঠিক পাশের নরম মাংসের উপরে ভর দিয়ে সেতারে হাত বসাতে হবে। এটি হবে প্রথম শক্ত খূটি, যা সেতারকে একই অবস্থানে আটকে রাখতে সাহায্য করবে। শরীরের উপরের অংশের ঠিক কতটা ভর ব্যবহার করতে হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে ডান কাঁধের ভর নিয়ন্ত্রন করেই। কাঁধ স্বাভাবিক আছে কিনা দেখে নিতে হবে। ঠিক এইভাবে হাত রাখলেই, ডান কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত চোখের আন্দাজে, অর্ধেক হাত সেতারের তুম্বার সীমানা বেশ কিছুটা ছাড়িয়ে যাবে। এবার, হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি রাখতে হবে সঠিক জায়গাতে। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। ডান কব্জির ক্রিয়াকে অনেকটাই দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে এই আঙুল। সব সেতারেই বৃদ্ধাঙ্গুলি রাখার আদর্শ জায়গাটি চিহ্নিত করা থাকে। সেতারের নিচ থেকে (ব্রিজ থেকে) দেখলে, শেষ পর্দাটির (সাধারনত মা) ঠিক আগেই এই জায়গাটি খুঁজে পাওয়া যাবে। মূলত তুম্বা এবং ডান্ডা (ফ্রেটবোর্ড)-এর জোড়াটি লুকিয়ে রাখার জন্যেই এই যায়গাটিতে কিছু কারুকাজ করে দেয়া হলেও, কাকতালীয় ভাবে এই জায়গাটিই বুড়ো আঙুল রাখার আদর্শ স্থান এবং এই সংকেত নতুন শিক্ষার্থীদের খুবই কাজে লাগে। এবার বৃদ্ধাঙ্গুলি এখানে কিছুটা শক্ত করে বসিয়ে দিয়ে, বাকি চার আঙুল স্বাভাবিক মুদ্রায় তারের ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এক নজরে এবার ডান হাতের পুরোটা লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যাবে, ডান কাঁধ থেকে কনুইয়ের দিকটা ডান দিকেই গিয়ে সেতারের তুম্বার উপরে ভাসমান। কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত আবার বা দিকে (সেতারের শেষ পর্দার দিকে) মোড় নেবে কবজি পর্যন্ত এবং কবজি থেকে হাতের পাঞ্জা এবং আঙুলগুলো থাকবে নিচের দিকে, স্বাভাবিক ঝুলন্ত অবস্থায়। আঙুলগুলো কিছুটা একসাথে গুছিয়ে রাখলে আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠবে এই মুদ্রা।
চতুর্থ, তারে আঘাত করার নিয়ম। গুনিজনেরা সেতারের হাতেখড়ি পর্যায়ে, শিক্ষার্থীদের সাথে ডান হাতের মুদ্রার সঙ্গে আধুনিক বিশ্বের “বুলডোজার ক্ল”-এর সাথে তুলনা করেন। আঙুল নিয়ন্ত্রিত হয় কবজি দিয়ে, কবজি নিয়ন্ত্রণ করে কনুই এবং কনুই নিয়ন্ত্রণ করে কাঁধ। প্রতিটা যায়গায় এই সম্মিলিত শক্তি দিয়ে তারে আঘাত করবার চেষ্টা করতে হবে। শুধু আঙুল বা কবজির জোড় দিয়েও সেতার থেকে আওয়াজ বের করা সম্ভব, তবে এই উপায়ে সেতারের আওয়াজ কিছুটা তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। নতুন শিক্ষার্থীরা উপরে বর্ণিত আদর্শ কায়দাটির কথা মাথায় রেখে, প্রাথমিক ভাবে শুধু আঙুলের জোড় ব্যবহার করতে পারে।
এক্ষেত্রে তর্জনীর প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় জোড়া ব্যবহার করতে হবে। সেতারে দুই ধরনের স্ট্রোক আছে। নিচ থেকে উপরে উঠলে, একে “ডা” বলা হয় এবং উপর থেকে নিচের দিকে আসলে একে বলা হয় “রা”। আঙুল স্বাভাবিকভাবে সোজা রেখে, আঙুলের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করতে হবে “নায়কীর” তারে। আঘাত করার সময় হাত সোজা থেকে মুঠো প্রায় বন্ধ, এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে বারবার। প্রথমদিকে, সবগুলো তারে লাগার ফলে, আশানুরূপ ফল না পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেলেই চেষ্টা করতে হবে “ডা” স্ট্রোকে শুধু বাজ এবং জুড়ির আওয়াজে সীমাবদ্ধ রাখার। এক্ষেত্রে, আনুমানিক ৮০% বাজ এবং ২০% জোড়ের আওয়াজ আদর্শ মেনে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। “ডা” কিছুটা আয়ত্তে এলেই, “রা” স্ট্রোক করা যেতে পারে। “ডা” বাজাতে গিয়ে মুঠো বন্ধ হলে, সেখান থেকেই আবার উল্টো আঘাত করলেই “রা” বাজবে। “রা” এর ক্ষেত্রে, জোড়ের তার না বাজলে বিশেষ অসুবিধা না থাকলেও, অন্য কোন তারের আওয়াজ হতে দেয়া যাবেনা। এই অনুশীলনটি অন্তত এক সপ্তাহ চলমান রাখতে হবে, বেশ স্থির মনে, গতি খুব কম রেখে। চেষ্টা করতে হবে জোড়ালো আওয়াজ আনবার আর ধীরে ধীরে পাঞ্জা এবং আঙুলের শক্তি থেকে কাঁধ পর্যন্ত সম্মিলিত শক্তি ব্যবহার করবার।
সেতার থেকে আওয়াজ বের করবার সহজ উপায় নিয়ে সেতার গুরুকুলে ইংরাজি এবং বাংলায় বিস্তারিত ভিডিও টিউটেরিয়াল পাওয়া যাবে সেতার গুরুকুলে, দেখার আমন্ত্রন রইল। সেতার শিক্ষার যাত্রা শুভ হোক!
1 thought on “সেতার থেকে আওয়াজ বের করা [ সেতার শিক্ষা – পর্ব ৪ ]”