সেতার নিয়ে বসতে শেখা [ সেতার শিক্ষা – পর্ব ২ ]

সেতার নিয়ে বসতে শেখা নিয়ে আজকের আলোচনা। বিশ্বের যেকোন বাদ্যযন্ত্র ধরা এবং সেটা নিয়ে বসবার একটি বিশেষ কায়দা থাকে। যেহেতু সব মানুষের শারীরিক গঠন এক রকম নয়, সেহেতু যন্ত্র ধরবার নিয়ম ব্যক্তিভেদে খানিকটা হলেও বদলে যায়। সেতারও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা জানি, দুই ধরনের সেতার খুবই জনপ্রিয়। একটি খড়জ পঞ্চম, দ্বিতীয়টি গান্ধার পঞ্চম। এই দুই ধরনের সেতার ধরবার পদ্ধতি এবং মূল উপায় এক হলেও, কিছু বিষয়ের রকমফের লক্ষ্য করা যায়। সেতার ধরার পদ্ধতিগুলো নিয়েই আজকের লেখা।

ইমদাদখানি ঘরানার কথা উঠলে ওস্তাদ বেলায়েত খাঁ’র কথা আমাদের স্মরণ করতেই হবে। ওস্তাদ ইমদাদ খাঁ ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র ওস্তাদ এনায়েত খাঁ ছিলেন সেই সময়ের সেতার সম্রাট। বস্তুত আগ্রা শহর থেকে এই পরিবারের গল্পটি শুরু হলেও, ওস্তাদ এনায়েত খাঁ ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরে প্রধান সভাবাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওস্তাদ এনায়েত খা’র বড় সন্তান ওস্তাদ বেলায়েত খাঁ, আধুনিক ইমদাদখানি ঘরানার সেতারকে নতুন রূপে উপস্থাপন করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেতারের আওয়াজ, গঠন, বাদনশৈলী এবং ধরবার উপায় পুরোটা জুড়েই কাজ করেন ওস্তাদ বেলায়েত খাঁ। আমরা মূলত তাঁর দেখানো সেতার ধরার উপায় নিয়ে আজ কথা বলতে চলেছি।
শুরুতেই একটি ইতিবাচক মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক ধাপগুলো কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে, তবে এই অসুবিধাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে অনেকটা নিজ থেকেই। প্রথমে একধরনের আসনে আমরা বসব। এক্ষেত্রে, সমতলে সাধারণ আসন করে বসতে হবে। এরপর, ডান পায়ের গোড়ালি তুলে নিয়ে বাঁ-হাঁটুর ওপরে রেখে কিছুটা পদ্মাসনের মত করে বসতে হবে। এবার ডান পা বাঁ-উরুর ওপর দিয়ে এবং ডান উরুর নিচ দিয়ে বাঁ-পা চলে গেলে আমরা সেতার ধরবার জন্য প্রস্তুত। এসব ক্ষেত্রে, ডান হাঁটু স্বভাবতই অনেকটা উঁচু হয়ে থাকার কথা। এখন আমরা সেতার ধরে প্রথমেই “তুম্বা” রাখবো বাঁ পায়ের পাতার ঠিক মাঝখানের ভাজে। শুরুতে একটু অসুবিধা হতে পারে, তবে খুব তাড়াতাড়ি এই অসুবিধা ঠিক হয়ে যাবে। এবার আমরা সেতারের “ফ্রেট বোর্ড” উঠিয়ে বাঁ দিকের কাঁধ বরাবর আনুমানিক ৪৫° অ্যাঙ্গেলে উঁচু করে রাখবো, যার সাপোর্ট হিসেবে থাকবে আমাদের ডান হাঁটু। এই অ্যাঙ্গেল, মীড় বাজানোর ক্ষেত্রে অধিক সহায়ক। এই ক্ষেত্রে, ইমদাদখানি ঘরানার মহারথিদের সেতার ধরার কায়দা খুব ভালো ভালোভাবে খেয়াল রেখে একটি আয়নার সামনে অনুশীলন করা যেতে পারে।

ইমদাদখানি/গান্ধার পঞ্চম সেতারের যে রূপ আমরা এখন দেখতে পাই, সেটা ওস্তাদ বেলায়েত খানের সৃষ্টি। এমন সেতার আমাদের সম্মুখে আসে বিগত ষাট বছরের কাছাকাছি সময় ধরে। একসময় স্বয়ং বেলায়েত খাঁ, খড়জ পঞ্চম সেতার বাজাতেন। ইমদাদখানি ঘরানার পূর্বপুরুষদের সেতারও ছিল খড়জ পঞ্চম। খড়জ পঞ্চম সেতার বর্তমান রূপে দেখা যাচ্ছে তিন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে। আদি সেতার তিন তারের সমাহার হলেও, ১৮শ’ শতাব্দীর সেতারের পূর্ণাঙ্গ রূপের সাথে আজকের খড়জ পঞ্চম সেতারের রূপ মিলে যায় অনেকটাই।

বর্তমান সময়ে, খড়জ পঞ্চম সেতারের ব্যবহার দেখা যায় মূলত মাইহার ঘরানার সংগীতে। মাইহার ঘরানার সবচাইতে জনপ্রিয় সেতার শিল্পী পন্ডিত রবি শঙ্কর। এজন্য পন্ডিতজি’র পদ্ধতিগুলোকে আদর্শ উপায় বলে মেনে নেয়া যায়। এই ঘরানায় বাজানো হয় “খড়জ পঞ্চম” সেতার। গান্ধার পঞ্চম সেতার এবং খড়জ পঞ্চম সেতারের দৈহিক গঠনে খানিকটা সাদৃশ্য থাকলেও এর তব্লি “ডান্ডা” ও “ফ্রেট বোর্ড”-এর পুরুত্ব থেকে শুরু করে সাজ, অলংকার এবং আওয়াজ সম্পূর্ণ আলাদা। ফলশ্রুতিতে ইমদাদখানি সেতার, মাইহার ঘরানার সেতারের তুলোনায় ওজনে অনেক হাল্কা হয়। মাইহার ঘরানার বাজনায় আমরা মূলত “তন্ত্রকারি অঙ্গ” বা “instrumentalization” বাদন শৈলী শুনতে পাই। এমন বাজনায়, মূলত একটি যন্ত্রের সাংগীতিক উপাদানগুলোর সর্বচ্চ ব্যবহার শোনা যায়। আলাপ এবং জোড়ে ধ্রুপদি অঙ্গ এবং লয় বর্ধনের সঙ্গেই বদলায় বাজনার রূপ। খড়জ পঞ্চম সেতার ধরতে একই আসন করে বসতে হবে প্রথমে। গান্ধার পঞ্চম সেতার ধরতে যেমন এই আসনের মাধ্যমে বাঁ পা সেতারের ওজন ধরে রাখার বিশেষ ভূমিকা পালন করে, খড়জ পঞ্চমের ক্ষেত্রে এটি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারন সেতারের “ফ্রেটবোর্ড” আরও উঁচু স্থানে রাখা হয়। অর্থাৎ, কাঁধ ছাড়িয়ে কিছুটা ওপরে চলে যায় সেতার। এর ফলে, সেতারের ওজনের আকর্ষণ কেন্দ্রটি একটি সুবিধাজনক অবস্থায় নেয়া যায়, যার ফলে বাঁ হাতের গতি বাড়াতে খানিকটা সুবিধা হতে পারে। এমন বাজনায় সাধারণত “মীড়” বা “গমক” কিছুটা কম হওয়ায়, কাঁধ বরাবর রেখে মীড় টানার সুবিধাটির দরকার হয়না। খড়জের তারগুলোতে মিজরাবের আঘাত বেশি পড়লে, নায়কীর তারের আওয়াজ কিছুটা দমে যেতে পারে, তাই এই ধরনের সেতারের মূল বাজনায় সাধারণত খুবই স্পষ্ট এবং পরিমিত নায়কীর তারের আওয়াজ শোনা যায়, এবং এই কায়দায় সেতার ধরলে এটা আয়ত্তে আনা কিছুটা সহজ হয়।
খড়জ পঞ্চম সেতারে আরেকটু নিজস্বতা দিয়েছেন অনেকেই। এই মহারথিদের তালিকায় অন্যতম পন্ডিত দেবু চৌধুরী, পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ হালিম জাফর খাঁ’সহ আরও অনেকে। সেতারের এই মহান শিল্পীরা খড়জ পঞ্চম সেতার বাজালেও, আওয়াজ, বাদনশৈলী এবং সেতার ধরার কায়দা প্রত্যেকেরই আলাদা।
ঘরানাভেদে, যুক্তিসঙ্গত কারণেই সেতার ধরার কায়দাগুলো যেমন বদলেছে, তেমনি কালের বিবর্তনে একই ঘরানার বিভিন্ন শিল্পী নিজস্ব কিছু পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছেন। সেতার শেখার এই পথ পরিক্রমায় প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার সুবিধা অনুযায়ী বেশ কিছু কৌশল নিজেই অনায়াসে রপ্ত করে ফেলে। তবে, শুরুতে একটি নিয়ম সামনে রেখে এগিয়ে গেলে, বড় ধরণের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় অনেকটাই।

সেতার গুরুকুলের দ্বিতীয় পর্বে আমরা সেতার ধরতে শেখা নিয়ে একটি টিউটেরিয়াল বানিয়েছি যা দেখলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যাবে, দেখার আমন্ত্রণ রইল।

ReplyForward

1 thought on “সেতার নিয়ে বসতে শেখা [ সেতার শিক্ষা – পর্ব ২ ]”

Leave a Comment