আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সেতার অবয়ব।
সেতার অবয়ব
আমাদের দেশে সেতার যন্ত্রের বহুল প্রচার, সুতরাং ইহার আকার প্রায় সকলেই জানেন। তজ্জন্য সমুদয় অবয়বের বর্ণনা না করিয়া শুদ্ধ যে গুলি বাদ্যক্রিয়ার বিশেষ উপযোগী, তাহাই বলা বিধেয়। এ দেশ- প্রচলিত অধিকাংশ সেতার যন্ত্রেরই আকার প্রায় তিন হস্তপরিমিত, কিন্তু তদপেক্ষা বৃহদাকারেরও ব্যবহার হইয়া থাকে।
সেতারের খোল বা ধ্বনিকোষ, তব্লী বা ধ্বনিপট্টক, দাণ্ডা বা দণ্ড, পটরী বা অঙ্গুলিপট্টক, কাণ বা কীলক, তার বা তন্ত্র, পন্থি বা শালায়নী, সওয়ারী বা তন্ত্রাসন, মানুকা বা মানিকা, পর্দ্দা বা সারিকা, তাঁত বা তান্তবসূত্র এবং আড়ি বা সেতু এই গুলি বিশেষ প্রয়োজনীয়।
এতদ্ভিন্ন অন্য যাহা কিছু আছে, তৎসমুদয়ই অলঙ্কারমাত্র সেতারযন্ত্র, খোল ও দাণ্ডা এই দুই প্রধান ভাগে বিভক্ত। খোল অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত, অলাবু (লাউ) দ্বারা নির্ম্মিত, সুতরাং প্রায়ই গোলাকার। (খোলের উপরে নিবদ্ধ চক্রাকার কাষ্ঠফলককে তবলী বলে ; এই তলীর গোড়ায় যে অস্থি বা অন্য কোন ঘনপদার্থের এক খণ্ড আবদ্ধ থাকে, তাহার নাম পন্থি ; ঐ পন্থিতে তার সকল সংযোজিত থাকে।
পূর্ব্বোক্ত তলীর মধ্যস্থলে অস্থিনিৰ্ম্মিত যে চতুষ্কোণ পদার্থ থাকে, তাহাকে সওয়ারী বলে; ইহার এক পার্শ্বে সারি সারি কয়েকটা খাজ আছে, তাহার উপর দিয়া তারগুলি গিয়া পস্থিতে আবদ্ধ হয়।
তারের স্বর কিয়ৎপরিমাণে উচ্চ বা নিম্ন করিবার নিমিত্ত পন্থির সন্নিকটে সওয়া- রীর নিম্নে হস্তিদন্ত প্রভৃতি ঘনপদার্থ-নির্ম্মিত গোল বা অন্য আকারের যে পদার্থ থাকে, তাহাকে মানুকা বলে।
মানুকা তলীর উপরে থাকে ; ইহার ভিতর দিয়া নায়কী তার যায়; কেহ কেহ অপরাপর তারেও মানক। ব্যবহার করিয়। থাকেন। এই তারের স্বর অল্প পরিমাণে চড়া বা নরম করিতে হইলে ইহাকে নিম্নে বা ঊর্দ্ধে সঞ্চালিত করিতে হয় । তলীতে এই কয়েকটামাত্র থাকে।
খোল ও তলীর সহিত যষ্টির ন্যায় যে এক দীর্ঘ, স্বল্প পরিসর ও শূন্যগর্ভ কাষ্ঠখণ্ড সংযোজিত থাকে, তাহার নাম দাণ্ডা; উহার পশ্চাদ্ভাগ প্রায়ই গোল এবং সম্মুখভাগ সমতল ; এই সমতল ভাগকে সারিকাস্থান অথবা পটরি বলে।
ঐ পটরির উপরে ধাতুনির্ম্মিত যে সকল পলতোলা রেখা সারি সারি বসান থাকে, তাহা দিগের প্রত্যেকের নাম পর্দা, ইহাদের সংখ্যা কোন যন্ত্রে ষোল, কোন যন্ত্রে সতের; সতেরর অধিক প্রায়ই দৃষ্ট হয় না।
এই পর্দাগুলির বিন্যাস ইচ্ছামত হইতে পারে না; স্বরগ্রাম ও তৎপ্রসূতি দ্বাবিংশতি শ্রুতির অনুযায়ী করিয়া ইহাদিগকে বসাইতে হয়, সুতরাং ঐ পর্দাগুলি পরস্পর সমব্যবধানেও থাকে না।
উক্ত পর্দাগুলির অব্যবহিত উপরেই যে দুই অস্থিফলক সমান্তরালভাবে বসান থাকে, তাহাদিগের উভয়কেই আড়ি বলে। অস্থিভিন্ন অন্য কোন কঠিন পদার্থেরও আড়ি হইতে পারে ।
ঐ আড়ির প্রথমখানি অপেক্ষাকৃত উচ্চ, অপরখানি কেবল তারগুলি সংযত করিবার জন্যই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ইহাদিগের পরেই কাণ ৷ কাণের সংখ্যা পাঁচ; কোন কোন সেতারে ইহার অধিকও দেখা যায় । তন্মধ্যে দুইটা উপরে আর তিনটী বা ততোধিক পার্শ্বে সংলগ্ন থাকে ; এ গুলি অস্থি বা অন্য কোন কঠিন পদার্থেরও হইতে পারে।
আর দাণ্ডার পশ্চাৎ ভাগে যে, এক একটা সূত্রগুচ্ছদ্বারা প্রত্যেক সারিক| আবদ্ধ থাকে, তন্তুনির্ম্মিত বলিয়া তাহাদিগকে তাণ্ডবসূত্র বলা যায়। কিন্তু সামান্য সূতা বা রেসমের দ্বারাও সারিকাবন্ধন হইতে পারে। শক্ত হইবে, সুতরাং অনেক দিন যাইবে বলিয়া তাম্ভব- সূত্রই সচরাচর ব্যবহৃত হয়।
প্রত্যেক সারিক। ইচ্ছামত নড়ান যাইতে পারে, যে সকল সেতারের পর্দ্দা উচ্চ নীচ করিয়া নড়ান যায়, সে সকল সেতারের নাম সচলঠাট সেতার। এইরূপ পদাচালন পদ্ধতি কেবল সুরকে কোমল এবং তীব্র করিবার জন্য ব্যবহৃত হয়। এক্ষণে সেতারের অবয়ব একরূপ বলা হইল। ইহার উপর তার চড়াইলেই সেতার সম্পূর্ণ অবয়ব ধারণ করে।
সেতারের পূর্বতন সংস্কৃতনাম ত্রিতন্ত্রী। (তিনটী তন্ত্রবিশিষ্ট যে যন্ত্র, তাহাকেই সংস্কৃতভাষায় ত্রিতন্ত্রী বলে। বস্তুতঃ পূর্ব্বে ত্রিতন্ত্রীতে তিনটী করিয়। তার আবদ্ধ থাকিত। যেহেতু এখনও পশ্চিমদেশীয় কোন কোন সেতারে তিনটী তার সংলগ্ন থাকা।
দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু ইহা অতি বিরল। যাহা হউক, যবন রাজাদিগের রাজত্বকালে সঙ্গীতের ক্রিয়ানিদ্ধাংশ উহাদিগের নিকট বিশেষ আদৃত হওয়াতে কেহ কেহ বলেন, আমাদিগের সংস্কৃত নামের ঐক্য রাখিয়। আমীর খরু এই ত্রিতন্ত্রীর “সেতার” আখ্যা প্রদান করেন। পারসিক ভাষায় সে ” শব্দের অর্থ তিন এবং “তার” শব্দের অর্থ তন্ত্র।
যদিও এই যন্ত্রের সংস্কৃতানুযায়ী নাম ত্রিতন্ত্রী এবং পারসিক নাম সেতার, এতদুভয় শব্দে রই অর্থগত ঐক্য আছে বটে, কিন্তু কাৰ্য্যগত কোন ঐক্য সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না।
কারণ এক্ষণে ইহাতে সাধারণতঃ পাঁচটী তার যোজিত থাকে, এবং যন্ত্র বড় হইলে উক্ত পাঁচটী ব্যতীত আরও তিন চারিটী অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তার আবদ্ধ থাকা দেখিতে পাওয়া যায় ৷
এই শেষোক্ত তারগুলির নাম চিকারী বা পার্শ্বতন্ত্রিক।। সংস্কৃত- সঙ্গীত গ্রন্থকর্তারা যে নানাবিধ বীণার নাম নির্দ্দেশ করিয়াছেন, তন্মধ্যে ত্রিতন্ত্রীও অন্যতর বীণাজাতির মধ্যে পরিগণিত। তদনুসারে ইহার নাম জিতন্ত্রী বীণা, আর এতদ্দেশে কচুয়া সেতার নামে চেপ্টা রকম এক-প্রকার সেতারের ব্যবহার আছে, তাহার সংস্কৃত নাম কচ্ছপী বীণা ।
যাহাই হউক, ত্রিতন্ত্রী বীণা এবং কচ্ছপী বীণা এতদুভয়ই সৰ্ব্বসাধা- রণতঃ সেতার বলিয়। প্রসিদ্ধ। (আমাদিগের বর্ণমান সেতারে পাঁচটী তার আবদ্ধ থাকিবে। উক্ত পাঁচটী ারের মধ্যে তিনটী পিত্তলের, অপর দুইটা পাকা লৌহনিৰ্ম্মিত ।
সামান্যতঃ পিত্তলের তারগুলিকে কাঁচা, আর লৌহের দুইটীকে পাকা তার বলে। ইহাদের মধ্যে চারিটী লৌহের হইলেও হানি নাই, কিন্তু একটা পিত্তলের অথবা অন্য কোন কাঁচা ধাতুর হওয়া আবশ্যক ।
কোন্ তারটী কোন্ সুরে বাঁধা থাকে, শিক্ষার্থী দিগের সহজে বোধগম্য হইবার জন্য নিম্নভাগে একটী সেতারের প্রতিকৃতি অঙ্কিত হইল। ঐ সেতারের উপরিস্থিত তারজড়িত পাঁচটা কাণে এক, দুই করিয়া চিহ্ন নির্দিষ্ট করা হইয়াছে ।
আরও দেখুনঃ

