ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তারজাতীয় বাদ্যযন্ত্র হলো সেতার। এর গঠন, তারের প্রকারভেদ, সুর নির্ধারণের নিয়ম এবং বাজানোর কৌশল দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক উন্নতি ও সংস্কারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট রূপ পেয়েছে। সেতার সাধারণত মেলোডি তার, ড্রোন (চিকারী) তার, পঞ্চম তার, ষড়জ তার এবং সহানুভূতিশীল (তারাব) তার নিয়ে গঠিত। প্রতিটি তারের সুরধ্বনি ও ধাতব প্রকৃতি আলাদা উদ্দেশ্যে নির্ধারিত।
সেতার যন্ত্র
সেতারের ইতিহাস
সেতারের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। অধিকাংশ সংগীতবিদের মতে, এর বর্তমান রূপ মধ্যযুগে (১৮শ শতাব্দীতে) গঠিত হয়।
- উৎপত্তি: ধারণা করা হয়, সেতারের পূর্বসূরি ছিল ইরানি তানপুরা ও সেতার (Seh-Tar), যা মুঘল আমলে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় তন্ত্রীযন্ত্র যেমন বীণা-এর প্রভাব নিয়ে পরিবর্তিত হয়।
- নামকরণ: ‘সেতার’ শব্দটি ফারসি Seh-Tar থেকে এসেছে, যার অর্থ “তিন তার”। প্রাথমিক পর্যায়ে এর তিনটি প্রধান তার ছিল। সময়ের সাথে এর তারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
- বিকাশ: ১৮শ শতকে আমির খুসরো (পুত্র) বা আমির খুসরো II এর নাম এর বিকাশের সাথে যুক্ত। ১৯শ ও ২০শ শতকে ভিলায়েত খান, রবি শঙ্কর, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কিংবদন্তি শিল্পী এর প্রযুক্তিগত ও রাগসংগত পরিমার্জন ঘটান।
- আধুনিক রূপ: বর্তমানে সেতারের দুটি প্রধান ধারা রয়েছে — গান্ধার পঞ্চম সেতার এবং খারজ পঞ্চম সেতার, যাদের কাঠামো ও সুর বিন্যাসে পার্থক্য রয়েছে।
প্রধান তারের বিন্যাস
১. জুড়ী তার (২) ও (৩) চিহ্নিত তার)
- এ দুটি তার সমান উচ্চতায় (স্থরে) বাঁধা থাকে এবং এজন্য এদের বলা হয় জুড়ী তার।
- সাধারণত পিত্তল দ্বারা নির্মিত হয়, যা উজ্জ্বল ও দীর্ঘস্থায়ী ধ্বনি তৈরি করে।
- জুড়ী তারের কাজ হলো মেলোডিক লাইনকে সাপোর্ট করা ও ধ্বনির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করা।
- বাজানোর সময় এরা একসাথে প্রতিধ্বনি তৈরি করে সুরকে ঘনত্ব প্রদান করে।
২. নায়কী তার (১ চিহ্নিত তার)
- জুড়ী তারের মাঝ বরাবর বাঁধা থাকে।
- ধাতব গুণমানের জন্য এটি সাধারণত পাকা লোহার (স্টিল) তৈরি হয়।
- নায়কী তার মূলত প্রধান সুর বাজানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং বাজানোর সময় সর্বাধিক প্লাক করা হয়।
- এর সুরধ্বনি উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এটি সেতারের প্রধান গায়কী সুর বহন করে।
৩. পঞ্চম তার (৪ চিহ্নিত তার)
- পাকা লোহার তৈরি।
- সাধারণত পঞ্চম (Pa) সুরে বাঁধা হয়, তবে রাগভেদে গান্ধার (Ga), মধ্যম (Ma) ইত্যাদিতেও বাঁধা যেতে পারে।
- এটি ড্রোন স্ট্রিং হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বাজানোর সময় সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিধ্বনি তৈরি করে।
- কিছু বাদক পঞ্চম তারের অবস্থান পরিবর্তন করে চতুর্থ ও পঞ্চম তারের স্থান অদলবদল করেন, তবে ধাতব গুণমান অপরিবর্তিত থাকে।
৪. ষড়জ তার (৫ চিহ্নিত তার)
- সাধারণত পিত্তল বা অন্য কাঁচা ধাতুর তৈরি হয়।
- নিম্ন সা (Low Sa বা Kharaj Sa) তে বাঁধা হয়, যা গভীর ও ভারী ধ্বনি তৈরি করে।
- কাঁচা ধাতুর গুণে নিম্ন সুরের উষ্ণতা ও প্রাকৃতিক প্রতিধ্বনি বজায় থাকে।
চিকারী তার (Drone Strings)
- কিছু সেতারে পাঁচটি প্রধান তারের বাইরে অতিরিক্ত চিকারী থাকে।
- এগুলো সাধারণত দাণ্ডের (Neck) ডান দিক বরাবর পার্শ্বে সংযুক্ত ছোট ছোট টিউনিং পেগে বাঁধা থাকে।
- চিকারী সাধারণত উচ্চ সা বা পঞ্চম সুরে বাঁধা হয় এবং তান, ঝালা ও আলাপ পর্যায়ে রিদমিক ড্রোন প্রদান করে।
- বাজানোর সময় মূল সুরের সাথে এই চিকারীগুলো মিশে গাঢ় ও পূর্ণাঙ্গ সাউন্ডস্কেপ তৈরি করে।
সহানুভূতিশীল তার (Tarab Strings)
- প্রধান ফ্রেটবোর্ডের নিচে বাঁধা থাকে।
- বাজানোর সময় সরাসরি প্লাক না করেও এরা সহধ্বনি (Sympathetic Resonance) তৈরি করে।
- সাধারণত ১১–১৩টি থাকে এবং রাগ অনুযায়ী আলাদা সুরে বাঁধা হয়।
বিভিন্ন নির্মাণ বৈশিষ্ট্য
- ধাতব সংমিশ্রণ: সেতারের বিভিন্ন তারে লোহা ও পিত্তলের ব্যবহার সুরের উজ্জ্বলতা ও উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করে।
- তালের সাথে সামঞ্জস্য: ড্রোন স্ট্রিং এবং চিকারী বাজিয়ে রিদম ও মেলোডিকে সমানভাবে মিশিয়ে বাজানো হয়।
- টিউনিং পদ্ধতি: রাগ, গায়কি বা বাজানোর ধরন অনুযায়ী প্রধান তারের টিউনিং পরিবর্তন করা হয়।
বাজানোর কৌশল:
- সেতার বাজানোর কৌশল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং সূক্ষ্ম। প্রধানত নিম্নলিখিত দিকগুলোতে কুশলতা প্রয়োজন:
- মীড় (Meend): তার টেনে দীর্ঘ সুরের বাঁক সৃষ্টি করা। সেতারে মীড় ৪–৫ নোট পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব, যা অন্য যন্ত্রে বিরল।
- গমক (Gamak): দ্রুত সুর পরিবর্তন ও স্পন্দিত ধ্বনি তৈরি।
- আন্দোলন (Andolan): সুরের ধীরে ধীরে দোলন, যা রাগের আবেগ ফুটিয়ে তোলে।
- চিক্কার (Chikkar): চিকারী তার দ্রুত আঘাত করে ঝঙ্কার সৃষ্টি করা, যা ঝালা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- ঝালা (Jhala): দ্রুত তালে প্রধান সুর ও চিকারী একসাথে বাজিয়ে তীব্র প্রতিধ্বনি তৈরি করা।
- আলাপ (Alap): রাগের ধীর ও ভদ্র প্রারম্ভিক পরিবেশনা, যেখানে লয়ের ব্যবহার নেই।
- তান (Taan): দ্রুত গতির সুরের বিন্যাস, যা উচ্চমানের আঙুলের দক্ষতা দাবি করে।
- মুটিং (Muting): আঙুল দিয়ে তারের কম্পন থামিয়ে নির্দিষ্ট সাউন্ড ইফেক্ট তৈরি করা।
সুরের প্রভাব ও ব্যবহার:
- আবেগ প্রকাশ: নায়কী তার ও মীড়ের মাধ্যমে রাগের গায়কী-ধর্মী সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়।
- রিদমিক সৌন্দর্য: চিকারী ও পঞ্চম তার ঝালায় ব্যবহার করে তালের প্রাণবন্ত রূপ তুলে ধরা হয়।
- রাগভেদে টিউনিং: প্রতিটি রাগের জন্য তারাব ও প্রধান তারের আলাদা সুর বিন্যাস প্রয়োজন, যা পরিবেশনার আবহ নির্ধারণ করে।
সেতার কেবল একটি সহযোাগী বাদ্যযন্ত্র নয়; এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একক প্রতিনিধিত্বশিল শিল্প। এর ধাতব তারের ধ্বনি, সহানুভূতিশীল তারের প্রতিধ্বনি এবং বাজানোর সূক্ষ্ম কৌশল মিলে সেতারের সুরকে করে তুলেছে গভীর, গম্ভীর ও আবেগময়।

