বিশ্বের জনপ্রিয় তারযন্ত্রগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানে যে নামটি আসে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সেতার। ‘সেতার’ শব্দের অর্থ ‘তিন তারের সমাহার’, যা ফারসি শব্দ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। ধারণা করা হয়, ১৩শ শতাব্দীর ফারসি তারযন্ত্র সেহতার, ‘কচ্ছপ/কচ্ছুয়া বিনা’ অথবা ‘তানপুরা–সেহতার–বীণা’-এর মিশ্র প্রভাব থেকেই সেতারের উদ্ভব। যদিও এই তত্ত্বের পক্ষে শক্ত প্রমাণ নেই, তবুও সেতারের আবিষ্কর্তার মর্যাদা প্রায়ই দেওয়া হয় ১৮শ শতাব্দীর সুফি সংগীতজ্ঞ, মিয়া তানসেনের বংশধর আমির খুসরোকে।
পরবর্তীতে একই পরিবারের দুই সদস্য, মসীদ খান এবং রাজা খান, সেতারের কাঠামো ও সুর বিন্যাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করেন। যুগে যুগে নানা ঐতিহাসিক সেতারশিল্পীর হাত ধরে সেতারের আঙ্গিকে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন, যা সেকাল ও একালের সেতারের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করেছে।
![সেতার পরিচিতি [ সেতার শিক্ষা - পর্ব ১ ]](https://sitargoln.com/wp-content/uploads/2023/04/Sitar-Instrument-200x300.jpg)
সেতার পরিচিতি
সঙ্গীতে সেতারের স্থান
উপমহাদেশে কণ্ঠসংগীতকে সবসময়ই বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এ অঞ্চলের অধিকাংশ বাদ্যযন্ত্র কণ্ঠনির্ভর বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে এবং সাধারণত কণ্ঠের মতোই তিন সপ্তকের বেশি সুরের পরিসীমা অতিক্রম করে না। এখানকার প্রায় সব বাদ্যযন্ত্রের সূচনাই হয়েছে কণ্ঠসঙ্গতের যন্ত্র হিসেবে। পরবর্তীতে একক পরিবেশনার যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে প্রতিটি যন্ত্রকে একপ্রকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সেতারও এর ব্যতিক্রম নয়।
ঘরানা ও শৈলী
শুদ্ধ সংগীতে ‘ঘরানা’ শব্দটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ‘ঘর’ থেকে উদ্ভূত এই শব্দটি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সঙ্গীতশৈলীকে বোঝায়, যা কোনো খ্যাতিমান পরিবার বা গোষ্ঠীর সংগীত ঐতিহ্যের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। সেতারের প্রায় দশটির মতো ঘরানা রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো –
- ইমদাদখানি / ইতাওয়া / ভিলায়েতখানি ঘরানা
- মাইহার ঘরানা
এই ঘরানাগুলোর বাদনশৈলী, আওয়াজের স্বরধ্বনি, তারের সমাহার এবং ভেতরের প্রযুক্তিগত কাঠামোতে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
আধুনিক সেতারের দুই কিংবদন্তি
বর্তমান শতাব্দীর দুই কিংবদন্তি সেতারশিল্পী—
- উস্তাদ বেলায়েত খান (ইমদাদখানি ঘরানা)
- পণ্ডিত রবি শঙ্কর (সেনিয়া মাইহার ঘরানা)
তাদের হাত ধরেই সেতার বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে এবং আধুনিক রূপ লাভ করেছে। বেলায়েত খানের বাজনাকে বলা হয় ‘গায়াকি অঙ্গ’—যেখানে কণ্ঠসংগীতের সূক্ষ্মতা ও আবেগ প্রধান। অপরদিকে রবি শঙ্করের বাজনাকে বলা হয় ‘তন্ত্রকারি অঙ্গ’—যেখানে যান্ত্রিক দক্ষতা ও জটিল প্রযুক্তিগত নৈপুণ্য বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়।

সেতার তৈরির উপাদান:
সেতার নির্মাণে কিছু নির্দিষ্ট ও বিশেষ উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা এর সুর, স্থায়িত্ব এবং মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে প্রধান উপাদানগুলো হলো—
-
বিশেষ ধরনের কুমড়া
-
জার্মান সিলভার দিয়ে তৈরি পর্দা (ফ্রেট)
-
প্রক্রিয়াজাত কাঠ
-
বিশেষ ধরনের সুতার তার
-
হাড় বা তামার তৈরি কিছু যন্ত্রাংশ
বিশেষ কুমড়ার ব্যবহার
বিশ্বজুড়ে সেতার ও তানপুরার উচ্চ চাহিদার কারণে ভারতে বিশেষ ধরনের খাবার-অযোগ্য কুমড়ার চাষ হয়। এই কুমড়া সেতারের আওয়াজে গভীরতা ও অনুরণন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নির্দিষ্ট পর্যায়ে পাকলে কুমড়াটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে মসৃণ করা হয়, যাতে এটি সেতার তৈরির উপযোগী হয়।
কাঠের নির্বাচন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ
সাধারণত সেতার তুন কাঠ বা সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি হয়।
-
তুন কাঠ: সুরে কোমলতা আনে, কিন্তু আর্দ্রতার প্রভাবে পরিবর্তন ঘটতে পারে।
-
সেগুন কাঠ: তুলনামূলক বেশি মজবুত এবং আর্দ্রতার পরিবর্তনেও স্থায়িত্ব বজায় রাখে।
সেতারের জন্য কাঠ প্রস্তুত করতে দীর্ঘ সময় লাগে। কাঠকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বহু বছর ধরে শুকিয়ে এর ভেতরের আর্দ্রতা কমানো হয়, যাতে সেতার তৈরির পর তার সুর গভীর ও গম্ভীর হয়। কাঠ যত পুরনো হয়, সেতারের গুণমান ও বাজারমূল্য তত বাড়ে।
প্রাথমিক অবয়ব নির্মাণ
কাঠ এবং কুমড়ার ভেতরের অংশ বিশেষভাবে ফাঁপা করে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়। এই কাঠামোই সেতারের প্রাথমিক অবয়ব, যার ওপর ধাপে ধাপে অন্যান্য অংশ সংযোজন করে চূড়ান্ত যন্ত্রটি তৈরি হয়।

সেতারের গঠন
সেতারের তারসংখ্যা সাধারণত ১৮ থেকে ২১ পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে একটি মূল তারসহ ৬-৭টি প্রধান তার থাকে। বাকি তারগুলো থাকে ভেতরের স্তরে, যেগুলোর মূল কাজ হলো বিভিন্ন স্বরের সঙ্গে অনুরণন সৃষ্টি করা। এই ভেতরের স্তরের তারকে বলা হয় “তরফ” বা “তরফদার”।
এই সব তারকে ধরে রাখার জন্য নির্দিষ্ট মাপের “কান” বা “খুটি” ব্যবহার করা হয়, যা সঠিক আকারের ছিদ্র দিয়ে বসিয়ে শক্তভাবে আটকে রাখা হয়। মূল কাঠামো তৈরি হয়ে গেলে, শিল্পীরা নিখুঁতভাবে হালকা থেকে ভারী নকশার সূক্ষ্ম কারুকাজ করে সেতারকে সাজিয়ে তোলেন। বার্নিশ বা রঙ করা হয় বিশেষ সুতার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দূরত্বে পর্দাগুলো বেঁধে দেওয়ার ঠিক আগে। এরপর সেতারে বসানো হয় ব্রিজ।
ব্রিজের ভূমিকা
প্রায় সব তারযন্ত্রেই ব্রিজ থাকে, যার মূল কাজ হলো তারের কম্পন যন্ত্রের ভেতরে সঞ্চারিত ও প্রসারিত হওয়ার সেতুবন্ধন তৈরি করা। সেতারে ব্রিজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ঐতিহ্যবাহী উপকরণ: হাড়, শিং, হাতির দাঁত, কাঠ
- আধুনিক উপকরণ: সেলুলয়েডের ব্রিজ, যা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়
উৎপাদন ও জনপ্রিয়তা
বিশ্বজুড়ে সেতারের জনপ্রিয়তা থাকলেও এর প্রধান উৎপাদন হয় ভারতে। সেতার তৈরির দক্ষ কারিগরের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও বিখ্যাত দুটি প্রতিষ্ঠান হলো—
- কলকাতার হিরেন রায়
- দিল্লির রিখি রাম
এদের তৈরি সেতারের দাম সাধারণত ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে লাখ টাকার উপরে পর্যন্ত হয়। এই সেতারগুলো মান, কারিগরি ও সুরের জন্য অতুলনীয়, এবং উস্তাদ বেলায়েত খান, পণ্ডিত রবি শঙ্করের মতো বিশ্বমানের শিল্পীরা এগুলো বাজিয়েছেন।
তবে শুধু এই দুই ব্র্যান্ডই ভালো সেতার বানাতে পারে, এমন নয়। সারা ভারতেই বহু গুণী সেতার কারিগর রয়েছেন, বিশেষ করে মিরাজ অঞ্চলে অনেকেই দলবদ্ধভাবে কাজ করেন। অনলাইনে একটু খুঁজলেই তাদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করা সম্ভব।
সেতার বাজানোর প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম
সেতার বাজানোর জন্য শুধু যন্ত্র নয়, আরও কিছু জিনিস প্রয়োজন—
- মিজরাব (তারের আঘাত দেওয়ার পিক)
- তরফের খুটি ঘোরানোর বিশেষ চাবি
- একটি ছোট পাত্রে হালকা তেলে ভিজিয়ে রাখা তুলা (তার মসৃণ রাখার জন্য)
📺 সেতার গুরুকুলের প্রথম পর্বে, সেতার পরিচিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন নিশিত দে। ভিডিওটি দেখার আমন্ত্রণ রইল।
