সেতার পরিচিতি নিয়ে আজকের আলোচনা। বিশ্বের জনপ্রিয় তার যন্ত্রগুলর তালিকায়, প্রথম সারির একটি যন্ত্রের নাম সেতার। সেতার সব্দের অর্থ, তিন তারের সমহার, যা ফার্সি সব্দ থেকে এসেছে বলা হয়। ১৩’শতাব্দির ফার্সি যন্ত্র “সেহতার” থেকে, “কাছুয়া/কচ্ছপ’ বিনা থেকে কিংবা তানপুরা-সেহতার-বিনা থেকেই সেতার এসেছে এমন অনেক ধারনা সেতার কে কেন্দ্র করে বিরাজমান। তবে তেমন কোন শক্ত প্রমান না থাকলেও, সেতার আবিস্কারকের খেতাব মিয়া তানসেনের বংশোদ্ভুত ১৮’ শতাব্দির সুফি সঙ্গিতজ্ঞ আমির খুস্রকেই দেয়া হয়। পরবর্তীতে, একই পরিবারের দুই সদশ্য, মসিদ খান এবং রাজা খান, সেতার বাজনায় বেশ কিছু গুরুত্তপূর্ণ সং্যোযন করেন। জুগের বিভিন্ন ঐতিহাসিক সেতার শিল্পীর হাত ধরে, সেকাল-একালের সেতারের মধ্যে এসেছে, জুগান্তকারি পরিবর্তন।
সেতার পরিচিতি
এই অঞ্চলে, কণ্ঠসংগীতকেই সংগীতের অন্যতম মর্যাদা দেয়া হয়। অনেকটা একারনেই, উপমহাদেশের মোটামুটি সব যন্ত্রই কন্ঠনির্ভর এবং সাধারনত এর স্বরের পরিসিমা কন্ঠের মতই তিন সপ্তক পার হয় না। এ অঞ্চলের সব যন্ত্রের শুরই বিভিন্ন খেত্রের সঙ্গতযন্ত্র হিসেবে। একক পরিবেশনার বিষয় হতে, যন্ত্রির সঙ্গে নাড়া বেধে প্রত্যেক যন্ত্রকেই একটা সংগ্রাম দিয়ে যেতে হয়েছে।
শুদ্ধ সংগীতে “ঘরানা” কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। “ঘর” থেকে আসা “ঘরানা” দিয়ে সাধারনত একটা নির্দিষ্ট শৈলীকে বঝানো হয়, যা হয়ত কোন বিক্ষ্যাত .ঘর/পরিবারের সাঙ্গেতিক বৈশিষ্ট। সেতারের এমন প্রায় দশটির মত ঘরানা রইলেও, ইমদাদখানি/ইতাওাহ/ভিলায়াতখানি ঘরানা এবং মাইহার ঘরানাই সেতারের সব থেকে জনপ্রিয় ঘরানা। দুটি সেতারের বাদন শৈলি, আওাজের জোয়ারি, তারের সমাহার এবং দইহিক ও ভেতরগত কলাকৌশল অনেকটাই আলাদা। এই সতাব্দির দুই কিংবদন্তি সেতার শিল্পী, ইমদাদখানি ঘরানার বেলায়েত খান এবং সেনিয়া মাইহার ঘরনানার সেতার শিল্পী পন্ডিত রবি শংকরের হাত ধরেই সেতার বিশ্বখ্যাত হয় এবং এর সর্বশেষ রুপ ধারন করে। বেলায়েত খানের বাজনা কে “গায়াকি” অংগ এবং রবি শঙ্করের বাজনা কে “তন্ত্রকারি” অংগ বলা হয়।
সেতার তৈরির উপাদান:
এক বিশেষ ধরনের কুমড়া, জার্মান সিল্ভারের পর্দা (ফ্রেট), প্রক্রিয়াজাত কাঠ, বিশেষ একধরনের সুতা এবং হাড়/তামা, এগুলোই সেতার তইরির মূল উপাদান। বিশ্বেজূড়ে সেতার এবং তানপুরার ভালো চাহিদা থাকায়, ভারতে এই বিশেষ ধরনের কুমড়া চাষ করা হয়। খাবার অযোগ্য এই কুমড়া, সেতারের আওয়াজে এর আছে বিশেষ ভুমিকা। এই কুমড়া একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে গেলে, এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকীয়ে মসৃণ করে সেতার বানানোর উপযোগী করে তোলা হয়।
সেতার সাধারনত “তুন” কাঠ বা সেগুন কাঠের হয়। দুই ধরনের কাঠের আলাদা বিশেষত্ত থাকলেও, শেগুন কাঠের সেতার আরো মজবুত হওয়ায়, আদ্রতার পরিবর্তন ঘটলেও, তার প্রভাব এমন সেতারের উপরে অনেকংশেই কম পরে। সেতার হয়ে ওঠার আগে, এই কাঠ কে অপেক্ষা করতে হয় বহু বছর। কাঠ কে বিশেষ প্রক্রিয়ায় অনেকটা সময় রাখলে এর ভেতরের আদ্রতার পরিমান অনেক কমে আসে এবং সেতারে পরিনত হলে, তার আওয়াজের গাম্ভীর্য থাকে ততটাই দারুন। ব্রাণ্ডভ্যালু ছাড়াও, সেতারের বাজারমুল্য নির্ধারণের একটা বড় অংশই নির্ভর করে সেতারের কাঠের বয়স। কাঠ যতো পুড়ান, সেতারের দাম তোতোই বেশি। কাঠ এবং কুমড়ার ভেতোরটা চেছে ফাপা করে এক বিশেষ ভাবে জোড়া দিয়ে সেতারের প্রাথমিক অবয়বটি বানানো হয়।
ঘরানা এবং প্রকারভেদে:
সেতার ১৮-২১ তারের হতে পারে। এর মধ্যা একটি মূল তার শহ ৬-৭ প্রধান তার থাকে। বাকি সবগুলোই থাকে ভেতরের স্তরে, যার মূল কাজ বিভিন্ন স্বরের সংগে বেজে ওঠা। এই স্তরের নাম “তরফ” অথবা “তরফদার”। এই সবগুলো তার ধরে রাখার জন্য বানানো হয় সঠিক মাপের “কান” বাহ “খুটি”, যা একই মাপের ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে আঁটকে রাখা হয়। সেতারের মূল অবয়ব দারিয়ে গেলে, শিল্পীরা খুব নিখুতভাবে হাল্কা থেকে ভাঁড়ি নকশার কারুকাজ করে সেতার সাজিয়ে নেন। বার্নিশ/রঙ করা হয় বিশেষ সুতা দিয়ে বিশেষ দুরত্তে পর্দাগুলো বেধেফেলার ঠিক আগে। এরপর সেতারে “ব্রিজ” লাগানো হয়।
সাধারণত, সব তার যন্ত্রেই এক ধরনের ব্রিজ থাকে। এই ব্রিজের মূল কাজ, তারের কম্পন যন্ত্রের ভেতরে গিয়ে প্রসারিত হওয়ার সেতু হয়ে থাকা। সেতারে এর ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ হলেও, যন্ত্রভেদে, এই ব্রিজের গুরুত্তে বেশকম আসে। সেতারে, ব্রিজ মূলত হাড়, সিং, হাতির দাত এবং কাঠের হলেও, ইদানিং এক ধরনের “সেলুলয়েড” এর তৈরি ব্রিজ বেশ জনপ্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে সেতার বেশ জনপ্রিয় অন্ত্র হওয়ায়, যেকোন বাদ্যযন্ত্রের দোকানে এটা পাওার সম্ভাবনা ভালো। সারা বিশ্বে এর চাহিদা থাকেলও, এর মূল উৎপাদন ভারতেই হয়। সেতার বানায়, এমন কারিগড় ভারতে শতাধিক। তবে সবথেকে পুরাণো কলকাতার “হিরেন রায়” এবং দিল্লির “রিখি রাম” সব থেকে নাম করা। স্বাভাবিক ভাবেই, এদের সেতার বেশ দামি। পঞ্চাশ হাজার থেকে শুরু হয়ে লাখ পেরিয়ে যাওয়া সেতার এখানে পাওয়া যায়। এই সেতারগুলো এক কথায় অসাধারন। বেলায়েত খাঁ, রবি শঙ্কর সহ অনেক বিস্বমানের সেতার শিল্পীরা এই সেতারগুলো বাজিয়ে গেছেন।
এই দুই ব্রান্ড ছাড়া আর কেও ভালো সেতার বানাতে পারেন না, এমন কিন্তু না। সারা ভারতবর্ষেই অনেক গুনি সেতার কারিগর রয়েছেন। এদের অনেকেই দলবদ্ধ ভাবে আছেন ভারতের মিরাজে। একটু খুজলেই, এদের সবাইকেই খুব সহজে ্যোগাজোগ করা যাবে অনলাইনে। সেতার বাজাতে, যুন্ত্র ছাড়াও, মিজরাব, তরফের খুটি ঘোরানোর একটি বিশেষ চাবি, এবং ছোট একটি কৌটা লাগবে, যাতে হাল্কা তেলে চুবিয়ে রাখা তুলা থাকবে।
সেতার গুরুকুলের প্রথম পর্বটিতে, সেতার পরিচিতির ক্লাসটিতে এই বিষয় আলোচনা করেছেন নিশিত দে। ভিডিওটি দেখার আমন্ত্রন রইল।
আরও দেখুন: