সেতারের ঘরানা নিয়ে আজকের আলোচনা। সেতারের নানান ঘরানা রয়েছে। তাদের বাজনা তো আলাদা বটেই, অনেক ক্ষেত্রে যন্ত্রের গঠনও আলাদা। আজ সেতারের কিছু বিখ্যাত ঘরানা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সেতারের ঘরানা
এমদাদ খাঁ ঘরানা:
এ ঘরানা মূলত সেতার ও সুরবাহার ঘরানা। উনিশ শতকের শেষভাগে মধ্য ভারতে এর উদ্ভব। বাংলায় এ ঘরানার লালন ও সম্প্রসারণ করেন এমদাদ খাঁর পুত্র এনায়েত খাঁ। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সভাসঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি এ ঘরানার চর্চা করেন। এখান থেকেই তিনি বিশিষ্ট শিষ্যমন্ডলী গঠন করে এ ঘরানাকে উপমহাদেশে বিস্তৃত করেন।
সেনী-মাইহার ঘরানা এর স্রষ্টা বাংলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার শিবপুর গ্রামের বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ছিলেন তানসেনের জামাতা বংশীয় মিশ্রী খাঁ বা নৌবাৎ খাঁর শিষ্য রামপুর রাজ্যের নবাব হামেদ আলী খাঁর সভা-সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ। সঙ্গীত শিক্ষা জীবন শেষ করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাইহার রাজ্যের মহারাজা ব্রিজনারায়ণে সভা-সঙ্গীত নিয়োজিত হন। তিনি আমৃত্যু স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তাই গুরুর বংশ ও রাজ্যের নাম সংযোজন করে তাঁর সৃষ্ট ঘরানা সেনী-মাইহার নামে আখ্যায়িত হয়।
সেনী-মাইহার ঘরানা:
সরোদ ও সেতার বাদনের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের প্রচলিত বিভিন্ন বাজ ভিন্ন ভিন্ন গুরুর কাছে তালিম নিয়ে এ সব বাজের নির্যাস গ্রহণ করে এক নতুন বাজের সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন যন্ত্রের বাদন ঢংকে এক বাজ পদ্ধতি একীভূত করে এই বাজ নির্মাণ করেন। তিনি আলপ, জোড়, ঝালা, গৎ ইত্যাদি অনুক্রমকে একত্র করে এই বাজের সৃষ্টি করেন। তিনি রবাব, বীণা, সুরসৃঙ্গার, সেতার আর সুরবাহার যন্ত্র বাজাবার আঙ্গিকে সরোদ বাজাবার রীতি এবং শুদ্ধ ‘ডারা ডারা’ এবং ‘রাডা রাড়া’ বাজাবার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে তাঁর ঘরানা সঙ্গীতে এক অভূতপূর্ব বাজ প্রবর্তন করেন। সেনী-মাইহার ঘরানার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহ: তারপরনের কাজ, ঝালা বাজাবার ধারা পরিবর্তন, মিশ্ররাগের সৃষ্টি ও চমকপ্রদ প্রয়োগ।
বর্তমান ভারত, বাংলাদেশ ও বিশ্বে তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে সেনী-মাইহার ঘরনার সঙ্গীত বহুল প্রচলিত। এই ঘরানার প্রসিদ্ধ সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খান, তিমিরবরণ, পন্ডিত রবিশঙ্কর, অন্নপূর্ণা (রওশন আরা বেগম), ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, ওস্তাদ আলী আহমদ খান, ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান, ওস্তাদ ফুলঝুরি খান, ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, ওস্তাদ মীর কাশেম খান, ওস্তাদ খুরশীদ খান, পন্ডিত যতীন ভট্টচার্য, পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পন্ডিত ভি.জি. যোগ, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, শ্যামকুমার গাঙ্গুলী, শরণরাণী, শিশিরকণা ধরচৌধুরী, আশীষ খান, ধ্যানেশ খান, শাহাদত হোসেন খান, রীনাত ফওজিয়া, ইন্দ্রনীল ভট্টচার্য, শ্রীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ পরমাণিক, দ্যুতিকিশোর আচার্য চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বিষ্ণুপুর ঘরানা:
বিষ্ণুপুর ঘরানা হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের হিন্দুস্তানি ধারার ধ্রুপদ সংগীতের একটি ঘরানা। ১৮শ শতাব্দীতে এই ঘরানা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বিষ্ণুপুর শহরটি অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার সদর শহর। মধ্যযুগে এই শহরটি ছিল মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী। ঐতিহাসিকদের মতে, মল্লভূম ছিল পূর্বভারতের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মল্ল রাজারা ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার পৃষ্ঠপোষক। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে মল্ল রাজদরবারে বিষ্ণুপুর ঘরানার সূত্রপাত ঘটেছিল। বিষ্ণুপুর ঘরানা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একমাত্র ঘরানা যেটির কেন্দ্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের সময় থেকে বিষ্ণুপুর ঘরানায় খেয়াল গাওয়া শুরু হয়। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের প্রথম সারির সুরবাহার ও সেতার শিল্পী।
রামপুর ঘরানা:
প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশ শতকের মধ্যভাগে রামপুর দরবারের পৃষ্ঠপোষকতায়। এ ঘরানার উদ্ভবে তানসেন বংশীয় গুণীদের অবদান ছিল বলে একে সেনী ঘরানারই রূপান্তর মনে করা হয়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মাধ্যমে রামপুর ঘরানা বাংলায় প্রচলিত হয়। সেনী বংশের দবীর খাঁ ছিলেন বিখ্যাত সরোদিয়া। তিনি এ ঘরানা সঙ্গীত প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। বিখ্যাত সুরবাহার শিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ রামপুর ঘরনার সঙ্গীত বাংলাদেশে প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে বিপুল অবদান রাখেন। সরোদবাদক ফিদা হোসেন, সেতারবাদক পন্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান, প্রমুখ এ ঘরানারই অনুসারী। পদ্ধতিগত সম্পূর্ণতা এবং ধ্রুপদী মেজাজের সঙ্গে শ্রুতিমাধুর্যের সমন্বয়করণ এ ঘরানার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
আরও দেখুন:

