সেতার, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র, যার সুর মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং এক অভূতপূর্ব সংগীতজগতের জন্ম দেয়। ‘সেতার’ শব্দটি ফারসি শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো ‘তিন তার’। যদিও আধুনিক সেতারে সাধারণত চারটি প্রধান তার এবং আরো কয়েকটি সহায়ক তার থাকে। এই বাদ্যযন্ত্রটি প্রায় ৭০০ বছরের পুরানো এবং এটি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতশিল্পীদের দ্বারা জনপ্রিয় করা হয়। সেতার সুরের গভীরতা ও সৌন্দর্য এটির বিশেষত্ব। এটি একদিকে যেমন মনকে প্রশান্তি দেয়, তেমনি অন্যদিকে মানুষের অনুভূতিকে উজ্জীবিত করে।

সেতার সুর
সেতার সুরের মূল উপাদান
সেতারের সুর মূলত তৈরি হয় এর বিশেষ তার এবং কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। এটি লম্বা গ্রীবা, কাঠের শরীর এবং ধাতব তারের সমন্বয়ে গঠিত। সেতারে প্রধানত দুটি ধরনের তার থাকে—মেলোডিক তার (যা প্রধান সুর তৈরি করে) এবং ড্রোন তার (যা ব্যাকগ্রাউন্ড সুর তৈরি করে)। সেতারের বাঁশির মতো কণ্ঠস্বরের জন্য, শিল্পীকে দক্ষতার সাথে প্রতিটি তারে আঙুলের সঠিক চাপ প্রয়োগ করতে হয়।
সেতার বাজানোর জন্য বাঁ হাত দিয়ে সুর তৈরির কাজ করা হয় এবং ডান হাতের সাহায্যে বিভিন্ন তারে স্পর্শ করা হয়। এতে তৈরি হয় এক আশ্চর্য মেলোডি, যা সহজেই মানুষকে মোহিত করে। সেতারে মূলত তিনটি অংশ থাকে—দন্ড বা গ্রীবা, তবলা বা গাত্র এবং তার। দন্ডের উপর ধাতব ফ্রেট থাকে এবং এই ফ্রেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সুর ও রাগ বাজানো হয়।
সেতারের সুরের বৈশিষ্ট্য ও রাগধারা
সেতারের সুরকে সম্পূর্ণরূপে অনুভব করতে হলে, ভারতীয় রাগের ধারণা সম্পর্কে সামান্য হলেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সেতারে বিভিন্ন রাগ বাজানো হয়, যা দিনের বিভিন্ন সময় এবং ঋতুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংগীত পরিবেশন করতে সাহায্য করে। প্রতিটি রাগের আলাদা একটি মেজাজ, আবেগ এবং ভাব রয়েছে, যা সেতারের মাধ্যমে আরও গভীরভাবে প্রকাশিত হয়।
সেতারের রাগগুলো সাধারণত ধীর (আলাপ), মধ্যম (জোর), এবং দ্রুত (ঝালা) গতিতে বাজানো হয়। প্রত্যেকটি ধাপে শিল্পী তার দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সেতারের সুরকে শুদ্ধ ও মনোহর করে তোলেন। আলাপ হলো মূল সুর বা রাগের একটি ধীরগতির উপস্থাপনা, যেখানে রাগের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়। জোর হলো রাগের একটু দ্রুত গতির অংশ, যা শ্রোতার মনে সুরের আকর্ষণ তৈরি করে। ঝালা হলো রাগের দ্রুত এবং তীক্ষ্ণগতির অংশ, যেখানে শিল্পী সেতারের সমস্ত দক্ষতা প্রদর্শন করেন।
সেতারের বিভিন্ন ধরন
সেতার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রবিশঙ্কর সেতার ও বিলায়েত খান সেতার। রবিশঙ্কর সেতারে সাধারণত একাধিক সহায়ক তার থাকে, যা সুরকে আরও সমৃদ্ধ করে। বিলায়েত খান সেতারে সহায়ক তারের সংখ্যা কম এবং প্রধান সুর তৈরির তারের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে বিলায়েত খান সেতারে সুর অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও স্পষ্ট শোনা যায়।
সেতার সুরের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব
সেতার সুরের প্রভাব শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সুনাম অর্জন করেছে। বিশেষ করে পন্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ বিলায়েত খানের মতো মহান সেতারবাদকরা সেতার সুরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করে তুলেছেন। তাদের সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হয়ে অনেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রেমে পড়েছেন এবং সেতারকে একটি আন্তর্জাতিক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে স্থান দিয়েছেন।
বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের জর্জ হ্যারিসন পন্ডিত রবিশঙ্করের সাথে সেতার বাজানো শিখে এই বাদ্যযন্ত্রকে পশ্চিমা সংগীতের সাথে মিশিয়েছেন। এর ফলে সেতার সুরের প্রতি বিশ্ববাসীর আগ্রহ ও কৌতূহল বৃদ্ধি পায়। পাশ্চাত্য সংগীতের সাথে সেতারের সংমিশ্রণ একটি নতুন ধরনের সংগীতধারার জন্ম দেয়, যা ‘ফিউশন মিউজিক’ নামে পরিচিত।

সেতার সুরের আধুনিক রূপান্তর
বর্তমান সময়ে সেতার সুরের উপস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যদিও মূল রাগধারা ও শাস্ত্রীয় উপাদানগুলি অপরিবর্তিত রয়েছে, তথাপি আধুনিক প্রজন্মের সেতারবাদকরা সুরের বৈচিত্র্য আনতে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। ফিউশন মিউজিক, জ্যাজ, ও পপ সংগীতের সাথে সেতারের মিশ্রণ বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
অনেকেই এখন সেতারকে একক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে নয়, বরং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সাথে মিশিয়ে বাজাচ্ছেন, যেমন গিটার, ড্রামস, কী-বোর্ড ইত্যাদি। এর ফলে সেতারের সুর আরও নান্দনিক ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে। এর ফলে তরুণ প্রজন্মও সেতার সুরের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং তারা নতুন আঙ্গিকে সেতার বাজানোর চেষ্টা করছে।
সেতার শিক্ষার প্রক্রিয়া ও চর্চা
সেতার শেখা মোটেও সহজ নয়। এটি আয়ত্ত করতে দীর্ঘ সময় এবং কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। সাধারণত সেতার শেখার জন্য একজন গুরু বা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা নেওয়া হয়। প্রাথমিক অবস্থায় সুর তালিম, স্কেল প্র্যাকটিস এবং বিভিন্ন রাগের বেসিক সুর শেখানো হয়। এর পর ধীরে ধীরে রাগের জটিল অংশগুলি এবং ঝালা, তান বাজানোর কৌশল শেখানো হয়।
শিক্ষার পাশাপাশি নিয়মিত সেতার চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেতার বাজানোর সময় আঙুলের চাপ, তাল ও লয়ের সমন্বয়, এবং সঠিক শ্বাস-প্রশ্বাস বজায় রাখা প্রয়োজন। এর সাথে সাথে রাগের মেজাজ ও ভাব বুঝে সুর তৈরি করতে হবে। এভাবে সেতারের সুর চর্চার মাধ্যমে একজন শিল্পী তার নিজস্ব শৈলী তৈরি করতে সক্ষম হন।
সেতারের সুর শুধুমাত্র একটি বাদ্যযন্ত্রের সুর নয়; এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি গভীরতম অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। সেতারের প্রতিটি সুর, প্রতিটি রাগ, প্রতিটি তান মানব মনের এক নিখুঁত প্রকাশ ঘটায়। সেতার এমন একটি বাদ্যযন্ত্র, যা শুনলে মানুষের মনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায় এবং মনে এক নতুন আনন্দের সঞ্চার ঘটে।

এই সুরের মাধ্যমে মানুষ শুধু সংগীতের রস আস্বাদন করে না, বরং জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য ও শান্তিকেও উপলব্ধি করতে পারে। যুগ যুগ ধরে সেতারের সুর আমাদের শোনাচ্ছে ভালবাসার, প্রকৃতির, মানবতার গল্প—যা আমাদের হৃদয়কে আবেগে ভরিয়ে দেয় এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে শেখায়।
আরও দেখুন:
